বোঝান ওদের
আজকাল বেশির ভাগ পরিবারেই একটি করে ছেলেমেয়ে। ওদের ভালবাসতে গিয়ে শাসনের সীমানা ছোট করে ফেললে জীবন-বিকাশ কি সুস্থতার পথে চলতে পারে?
জীবনের বিকাশের স্তরে কৈশোর এক মাধুর্যময় সময়। সে তখন পূর্ণ শিশুও নয়, সম্পূর্ণ পরিণতও নয়। মা-বাবার আদরের বেড়াজালও যেমন আছে, তেমনই নীতিশিক্ষার বহরও তখন পর্যন্ত যথেষ্ট ছড়ানো। একটু বড় হওয়ার দিকে এগিয়ে যেতে বড়দের মতো জীবন তাদের কাঙ্খিত। কিন্তু সামাজিক শিক্ষায় তুলে ধরা দরকার তাদের এক্তিয়ারের সীমা। ওদের বোঝার ও বোঝানোর দায়িত্ব যে আমাদের, বড়দের।
আজকের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে এই জায়গাটাতেই অসুবিধা চোখে পড়ছে। অর্থাৎ, মা-বাবার আদরের সীমা প্রকট, কিন্তু নিষেধের বেড়াজাল ক্রমে ক্ষীণ হয়ে আসছে। ফলে ঘটনার পুনরাবৃত্তি— অনেক অনেক আবেশ হারিয়ে যাচ্ছে জীবনের ছবি থেকে। নানা ভাবে, নানা কারণে। এই দুর্ঘটনাগুলোয় একটা দুটো বিষয় বারবারই চোখে পড়ছে। কিশোরদের উচ্ছৃঙ্খলতা ও সেই আচরণের পরিধিতে মাদকের ব্যবহার। কোথা থেকে শিখছে ওরা? আর কেনই বা এমন আচরণ? মনস্তত্ত্বের বিচার বলছে অনেক কথা।
কৈশোরের অপরিণত মন প্রবৃত্তির তাগিদে সারাক্ষণ সুখ খুঁজছে। আজকের সমাজে ওরা সারা দিন উত্তেজনার খোরাক খুঁজতে ব্যস্ত, হয় মোবাইল নিয়ে, নয় ভিডিও গেম, না হলে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং-এ। প্রায় প্রতি মুহূর্তে হোয়্যাট্সঅ্যাপে চোখ রেখে, ফেসবুক পেজ খুলে সারা পৃথিবীর খবর রাখছে ওরা। এটাই নাকি জীবন চলার ধরন। সবাই তা-ই করে, সকলের সঙ্গে সকলে সারা দিন যুক্ত হচ্ছে, যুক্ত থাকছে। কে কী করল, কোথায় গেল, কোথায় যাবে— তার হদিস ছড়াতেই হবে। এ ছাড়া আছে উত্তেজনা-প্রণোদিত আলোচনা, খাওয়াদাওয়ার অভ্যেস, পারস্পরিক যোগাযোগে অনেকটা সময় ব্যবহার করা ইত্যাদি। প্রবৃত্তি বলছে, এগুলো কর। ওরা করছে। এক বারও ভেবে দেখছে না শান্ত হয়ে থাকার অনভ্যাস তার কত বড় ক্ষতি করছে। উদ্দাম শব্দে গান শোনা, উদ্দাম ভাবে নাচ, সবই উত্তেজিত রাখার নির্দিষ্ট ব্যবস্থা। সেখানে একটু-আধটু নেশার খোরাক শরীর-মনকে কিছুটা অবশ করে, ঠান্ডা রাখে। ফলত মাদকদ্রব্যের ব্যবহার।
কোথাও কোথাও মাদক ব্যবহারের কারণ শুনি কল্পনার জগতে নিয়ে গিয়ে ওদের তৃপ্তি দেয়, জগৎ-সংসারের চাপ থেকে মুক্তি দেয়। মাদকই নাকি সৃজনশীলতার উৎস। তবে সাধারণ ভাবে যখন এ ছবি আমাদের সামনে ফুটে উঠছে, তখন বুঝতে হবে এ সব উপাদানের ব্যবহারও ওরা স্বাভাবিক ধর্ম অর্থাৎ norm মনে করে। আর আজকাল আড়ালের প্রয়োজনও হয় না। ক্লাস এইট-নাইনের ছেলেমেয়েরাও একত্রিত হয়ে মজা করার সময়ে মদ্যপান করতে চায়।
আর এখানেই একটা বড় কারণ মা-বাবার দায়িত্বের গাফিলতি। আজকাল যে কোনও সামাজিক অনুষ্ঠানে মদ্যপানের ব্যবস্থা প্রায় স্টেটাস সিম্বল। বড়দের এত খোলাখুলি মদ্যপান করতে দেখেও ছোটরা একে স্বাভাবিক ব্যবহার মনে করে। মা-বাবা নিশ্চয়ই নিজেদের উৎসাহে ওদের এই উপাদান গ্রহণ করতে শেখান না। তবে এ বয়সের কিশোর-কিশোরীকে তাঁরা শাসনের আওতায় কঠিন ভাবে ধরেও রাখেন না। তাই ওরা নিজেরা ঠিক করে ডিজে পার্টিতে যায়, বন্ধুদের সঙ্গে নাইট-আউট করে। অভিজাত পরিবারে বলতে শুনেছি, ছেলেমেয়েরা অল্প বেশবাশে সারা রাত হুল্লোড় করে একই ঘরে পাশাপাশি শুয়ে পড়েছে। ফলে মনে হয় আত্মসংযম, নিজস্ব নিয়মের সীমারেখা, সঙ্কোচ, অস্বস্তির মানসিক অবস্থানগুলো নিয়ে এদের ভাবার অবকাশই নেই। সহজাত প্রবৃত্তি তো সবাইকে সারাক্ষণ হাতছানি দেবেই আপাত সুখের গণ্ডিতে পা রাখার জন্য। কিন্তু প্রকৃত সুখ বোঝার জন্য যে শাসন প্রয়োজন। বড়রা নিজেদের আচরিত ধর্মে সংযমের প্রয়োজনীয়তা দেখাতে না পারলে, ওরা যে মানছে না, মানবে না। ঘটনা-দুর্ঘটনায় বারেবারে পর্যবসিত হবে। সংশয়হীন, শঙ্কাহীন কৈশোর শুধু সংযমের অভ্যাসেই পাওয়া সম্ভব। কৈশোরের সবুজ আভা, না ছোট-না বড়র মাঝের যে হাল্কা সুখ— তা-ই জীবন। সেখানে মাদক নিয়ে ওরা ভাল-টা ভুলে থাকবে কেন? একটু ভাবব না আমরা?
(লেখক মনস্তত্ত্বের অধ্যাপক)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy