আলাপচারিতা: পাড়ার রকের পরিচিত দৃশ্য। —নিজস্ব চিত্র।
উত্তরে বাগবাজার স্ট্রিট আর দক্ষিণে গ্যালিফ স্ট্রিট, এই দুইয়ের মাঝে আমাদের পাড়া পশুপতি বসু লেন। মধ্যবিত্ত এই বাঙালি পাড়া এক কথায় নির্ঝঞ্ঝাট শান্তিপূর্ণ। রাস্তার পশ্চিমে রয়েছে নন্দলাল বসুর প্রাসাদোপম বাড়ির একাংশ। অতীতে বাড়ি সংলগ্ন একটি মাঠ ছিল। এখন কিছু অবশিষ্ট নেই। কারণ, সেখানেই গড়ে উঠেছে বাগবাজার মাল্টিপারপাস গার্লস স্কুল। আগে ওই মাঠেই ছিল একটি আখড়া।
এখানেই কাটিয়েছি জীবনের ছাপ্পান্নটা বছর। ইতিহাসের কত স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছে এই পাড়া। প্রবীণদের মুখে শুনেছি বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের রাখিবন্ধন উৎসবের সূচনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বসুবাড়ি সংলগ্ন এই দুই পাড়া।
অতীতে অন্যান্য পাড়ার মতো এখানেও বসত রকের আড্ডা। একটি রকে শুধুমাত্র প্রবীণদের আড্ডা বসত। এখন কর্মব্যস্ততার চাপে অবকাশের সঙ্গী হয়েছে টিভি-সহ অন্যান্য বিনোদনের মাধ্যম। ফলে আড্ডাটা আগের চেয়ে কমেছে। তবে রকে শুধু আড্ডাই নয়, গরম কালে মারাঠা ডিচ লেন ও গ্যালিফ স্ট্রিটের বস্তিবাসীরা বিছানা পেতে, মশারি টাঙিয়ে রকে শুতেন। সেই দৃশ্য আর দেখা যায় না। বস্তির ঘরে ঘরে রয়েছে পাখা-আলো।
পাড়াতেই এক সময় ভারত স্কাউট অ্যান্ড গাইডের শাখা ছিল। মাল্টিপারপাস গার্লস স্কুলের পাঁচিলের কাছে প্রতি দিন বিকেলে কুচকাওয়াজ চলত। বসুবাড়ির আরও একটি অংশ নিয়ে তৈরি হয়েছে রামকৃষ্ণ ডে স্টুডেন্টস হোম নামে সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত একটি লাইব্রেরি। পড়ুয়ার অভাবে লাইব্রেরিটা এখন ধুঁকছে। এরই ফুটপাথে রয়েছে শ্রীরামকৃষ্ণের সুসজ্জিত মূর্তি। পাড়ায় রয়েছে পরেশ বন্দ্যোপাধ্যায় শিশু উদ্যান এবং কবি বন্ধন নামে দু’টি সাজানো উদ্যান। এই জায়গাগুলি যেন কর্মব্যস্ত জীবনে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে দেয়।
আগে বৃষ্টিতে রাস্তায় জল জমত। কাগজের নৌকো ভাসিয়ে চেয়ে থাকতাম। সেই সমস্যা এখন নেই প্রায়। অতিবৃষ্টিতে জল জমলেও দ্রুত নেমে যায়। রয়েছে পার্কিং সমস্যা।
পশুপতি বোস লেন আর মারাঠা ডিচ লেনের মোড়ের কাছের এলাকাটা ঘন বসতিপূর্ণ। আগে ওই মোড়ের মাথায় পানের দোকানে ট্রানজিস্টার রেডিও বাজত। কোনও খেলা চললে ভিড় হত। আজ স্মার্টফোনের যুগে সেই রেডিও বাজে না। তবে মোড়ের দোকানে বসেই এখন ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপে খবর চালাচালি চলে।
এত পরিবর্তনের মাঝেও চায়ের দোকান কিংবা পানের দোকানের বেঞ্চে বসে আড্ডা, রাজনীতি কিংবা খেলা নিয়ে গলা ফাটানো বিতর্কের সেই ট্র্যাডিশন এখনও চলছে। এই নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির যুগেও আমাদের পাড়ার মোড়ে দাঁড়ালেই ‘প্রাণের মাঝে বিশ্বলোকের...’ সাড়া মিলবেই।
লেখক শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy