Advertisement
E-Paper

‘...সব যদি দিই সঁপিয়া তোমাকে’

নিজের টাকা খরচ করে মুম্বইয়ের রাস্তায় রাস্তায় গর্ত বুজিয়ে দেন দাদারাও বিলহোর। সংবাদপত্রের রিপোর্ট বলে, অন্তত ৬০০ গর্ত তিনি নিজে বুজিয়ে দিয়েছেন। দাদারাও বলেন, ‘‘প্রকাশের মৃত্যুর পরে আমাদের জীবনে এখন গভীর শূন্যতা। ওকে মনে রেখে এবং ওকে শ্রদ্ধা জানাতে এই কাজটা করি।

ঈশানী দত্ত রায়

শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০১৮ ০১:২১
ফাইল চিত্র

ফাইল চিত্র

নিজের টাকা খরচ করে মুম্বইয়ের রাস্তায় রাস্তায় গর্ত বুজিয়ে দেন দাদারাও বিলহোর। সংবাদপত্রের রিপোর্ট বলে, অন্তত ৬০০ গর্ত তিনি নিজে বুজিয়ে দিয়েছেন। দাদারাও বলেন, ‘‘প্রকাশের মৃত্যুর পরে আমাদের জীবনে এখন গভীর শূন্যতা। ওকে মনে রেখে এবং ওকে শ্রদ্ধা জানাতে এই কাজটা করি।

দাদারাওয়ের কিশোর পুত্র প্রকাশ। বন্ধুর সঙ্গে যাচ্ছিল মোটরবাইকে চেপে। মুম্বইয়ের রাস্তায় গর্তে পড়ে বাইক। ছিটকে পড়ে এবং মাথায় আঘাত পেয়ে প্রকাশের মৃত্যু হয়। তার পর থেকেই রাস্তায় রাস্তায় কোদাল, সিমেন্ট, বালি নিয়ে দেখা যায় দাদারাওকে।

তর্পণ?

সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের পেশাগত তাগিদে (অনেকেই বলেন, শকুনের মতো) বাৎসরিক স্মৃতিতর্পণ করতেই হয়। কোনও মর্মান্তিক মৃত্যুর নির্দিষ্ট সময় পর পর সেই পরিবারের খোঁজ নেওয়া। সংবাদকর্মীদের প্রায় প্রত্যেকের ভিতরে থাক থাক জমে এমন অজস্র শোক, স্মৃতি। ধীরে ধীরে হয়তো তা জমে কঠোর হয়, কিন্তু হারিয়ে যায় না। সমুদ্রতীরে আয়লানের উপুড় হয়ে পড়ে থাকা দেহ, নাগেরবাজারে বিস্ফোরণে মৃত আট বছরের বালকের সরল মুখ— সবই ফিরে আসে। হৃদ্‌যন্ত্র প্রতিস্থাপনের খবর লিখতে গিয়ে কারও মনে পড়ে, বিদেশের কোনও শহরতলিতে অপরিচিতের শরীরে মৃত সন্তানের হৃদ্‌যন্ত্রের শব্দ স্টেথোস্কোপ দিয়ে শুনছেন পিতা, অপরিচিতের প্রতিস্থাপিত মুখে হাত বুলিয়ে ভাইয়ের মুখ অনুভব করছেন বোন।

তর্পণ!

আবার প্রিয়জনের জামাকাপড়, জুতো তো বিলিয়ে দেন অনেকেই। জানতে ইচ্ছে করে, সেই জামা, শাড়ি, জুতো, চটি অন্য মানুষটির শরীরে তাঁদের দেখতে ইচ্ছে করে কি না? দেখলে কী মনে হয়? এ-ই সে? এখানে তো প্রতিস্থাপিত চোখ নেই, হৃদ্‌যন্ত্র নেই। আছে শুধু অঙ্গবিহীন স্মৃতি।

অন্ধকার থেকে আলো ফুটতে থাকা ভোরের মতো, অঞ্জলি ভরা তিল-জলের মতো, প্রত্যেকের ভিতরেই তর্পণের এমন নিজস্ব জায়গা থাকে। মানুষের, সময়ের, মুহূর্তের। প্রতিপদে ভাইফোঁটার পরদিন সকালে আমাদের বাঙাল বাড়িতে এক গণ্ডুষ মিশ্রণ খেতে দিত পিসিমণি। তাতে থাকত আখ, নারকেলের কুচি, নারকেল ও তালের ফোপরার টুকরো, মধু আর ঘাসের ডগা থেকে নেওয়া শিশির। গণ্ডুষই বলা হত তাকে। তর্পণ বা মহালয়ার সঙ্গে তার যোগ নেই। তবু ভোরে বড়জেঠুর তর্পণ করার দৃশ্য ভাবতে গিয়ে মাঠে, বাগানে শিশির সংগ্রহের কথাই মনে হল। মনে হল শিশির পড়া ঘাস, আকুল করা শিউলি, ছোটবেলায় স্কুলে বা বাড়িতে পাঁচিলের গায়ে পুরু শ্যাওলা-ফার্ন-মসের নিজস্ব জগতের কথাও। যা আমরা হারিয়ে ফেলেছি, কিন্তু যা ফিরে ফিরেই আসে।

একবার প্রিয়জনের স্মৃতিতে গাছের চারা পুঁততে গিয়ে ভিতরটা ধক করে উঠেছিল। চারা বসানোর পরে অভিজ্ঞ মালি বললেন, ‘‘মাটি দিন, জল দিন।’’ শেষকৃত্যের মতো। এবং তর্পণেরই মতো। হাতের আঁজলা ভরা জল পড়ল মাটিতে।

রবীন্দ্রনাথের মতো ভাবতে পারলে অবশ্য অসুবিধা নেই। ‘অল্প লইয়া থাকি তাই’ গানে তিনি লিখেছেন, ‘‘যাহা যায় আর যাহা-কিছু থাকে সব যদি দিই সঁপিয়া তোমাকে/ তবে নাহি ক্ষয়, সবই জেগে রয় তব মহা মহিমায়।’’ কিন্তু সব কিছু সঁপে দেব কী করে? আমাদের তো ‘‘যাহা যায় তাহা যায়।’’ নাগেরবাজারের কাজিপাড়ায় যে বালকের মৃত্যু হল বোমার আঘাতে, তার মায়ের কাছে গিয়ে কী বলবেন আপনি? বলবেন, কোথাও কিছু কম পড়ে নাই! মণ্ডপ বাঁধা চলছে, রাস্তায় পড়ছে পুজোর হোর্ডিং!

আমার কাকা এবং মামা মারা গিয়েছিলেন বালক বয়সে। আমাদের বাড়িতে তাদের সেই বালক বয়সের ছবিই বাঁধানো আছে। এমন রয়েছে বহু পরিবারেই। না-দেখা কাকা, মামা হিসেবে নয়, দুই বালক হিসেবেই রয়ে গিয়েছে তারা। অকালমৃত্যু মানুষটাকে সেই বয়সেই ধরে রাখে। আমাদের বয়স হয়। কিন্তু তারা সেই শিশু বা বালক-বালিকা হিসেবেই থেকে যায়। হয়তো এক সময় স্নেহের ভার্চুয়াল সম্পর্কও গড়ে ওঠে। বুদ্ধদেব বসু ‘আমার শৈশব’-এ তাঁর মায়ের কথা লিখেছিলেন। বুদ্ধদেবের জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই মা মারা যান।

বুদ্ধদেবের পিতৃদেব মৃত স্ত্রীকে নিয়ে ছবি তুলেছিলেন। বুদ্ধদেব লিখেছিলেন, ‘‘সে কেমন ছিলো— আমার নাৎনির বয়সী না-দেখা সেই মেয়েটি, কেমন ছিলো সে দেখতে, কেমন পছন্দ-অপছন্দ ছিলো তার...আমাকে জন্ম দেবার পরিশ্রমে যে-মেয়েটির মৃত্যু হয়েছিলো, তার কিছু প্রাপ্র্য ছিলো আমার কাছে, তা দেবার সময় এখনও হয়তো ফুরিয়ে যায়নি।’’

বহু বছর আগে মহালয়ার দিনে এই সংবাদপত্রের একটি জেলা সংস্করণে আট কলম জুড়ে একটি ছবি ছাপা হয়েছিল। চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে কাশের বন। উপরে স্ট্র্যাপ ছিল, ‘‘সে সুর শুনে খুলে দিনু মন’’। সুপ্রীতি ঘোষের গাওয়া গানের লাইন। গানের পরের দিকে আছে, ‘‘তোমায় হারা জীবন মম, তোমারই আলোয় নিরুপম’’। তোমায় হারা জীবন, কিন্তু তোমারই আলোয় সে নিরুপম, এ-ও তো প্রিয়জনেরই তর্পণ। নিজের মধ্যে তাঁকে নিরন্তর রেখে দেওয়া।

ভিতরে কোথাও কেউ বলে, ‘‘সে যে আসে, আসে, আসে।/ দুখের পরে পরম দুখে, তারি চরণ বাজে বুকে,/ সুখে কখন বুলিয়ে সে দেয় পরশমণি।’’ তর্পণের এমন গান! ফাঁসির সাত দিন আগে ২০ বছরের এক তরুণ আলিপুর সেন্ট্রাল জেল থেকে মাকে লিখেছিলেন, ‘‘যে মরণকে এক দিন সকলেরই বরণ করিয়া লইতে হইবে, সে আমাদের হিসাবে দুই দিন আগে আসিল বলিয়াই কি আমাদের এত বিক্ষোভ, এত চাঞ্চল্য? যে খবর না দিয়া আসিত, সে খবর দিয়া আসিল বলিয়াই কি আমরা তাহাকে পরম শত্রু মনে করিব?’’ তাঁর অন্যতম প্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীত হিসাবে বন্ধুমহলে ‘সে যে আসে, আসে, আসে....’ শুনিয়েছিলেন সেই তরুণই — বিপ্লবী দীনেশ গুপ্ত।

Mahalaya Durga Puja Durga Puja 2018 Tarpan
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy