দুটো আক্ষেপ রয়ে গেল। এক- বাবা আর কয়েকটা মাস বাঁচলে জেনে যেতে পারতেন তিনি পদ্মশ্রী হলেন। আর দুই- বাবার নাম পদ্মসম্মানের তালিকায় বেরনোর পর বাংলা সংবাদমাধ্যমগুলোতে সেই খবর বেরোল বটে, কিন্তু আর একটু বেশি করে তাঁকে, বিশেষত তাঁর কাজকে চেনানো যেত বোধহয়। মেয়ে হিসেবে এই দুটো প্রত্যাশাই আমার একান্ত ব্যক্তিগত। তবে বাবার মতো মানুষ, যাঁরা ধর্ম-বর্ণ-রাজনৈতিক সীমান্তের বেড়া টপকে এই বিশাল ভারতভূমির শিল্প, স্থাপত্যের শিকড় খুঁজেছেন, তাঁদের কথা আজকের প্রজন্মেরও জানা দরকার বলে মনে হয়।
১৯১৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি অশোক কুমার ভট্টাচার্যের হয় জন্ম উত্তর কলকাতায়। বাবা হরিমোহন ভট্টাচার্য, অর্থাত্ আমার ঠাকুরদা ছিলেন দর্শনের নামকরা অধ্যাপক। বাবার লেখাপড়া সাউথ সাবার্বান স্কুলে। পড়াশোনায় আজীবন প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হয়েছেন খুব কম বার। আইএসসি পাশ করার পর স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে সংস্কৃতে বিএ পাশ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংস্কৃতে এমএ পাশ করেন ১৯৪১ সালে, স্পেশাল সাবজেক্ট ছিল এপিগ্রাফি (সূত্র-লিপির পাঠোদ্ধার) এবং আইকনোগ্রাফি (মূর্তিশিল্প)। পরে ১৯৫২ সালে ইসলামি ইতিহাস ও সংস্কৃতি নিয়ে দ্বিতীয় এমএ। দু’বারই গোল্ড মেডালিস্ট। এর মধ্যে কবিতীর্থ, পুরানতীর্থে সম্মানিত হয়েছেন। আইন পাশ করেন ১৯৪৪ সালে। ১৯৪৯ সালে প্রেমচাঁদ রাইচাঁদ স্কলার। সেই বছরই ইন্ডিয়ান মিউজিয়মের (কলকাতায় যা জাদুঘর বলে পরিচিত) পুরাতত্ত্ব বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট কিউরেটর পদে যোগ দেন। এখানেই ১৯৬৫-৭৫ দীর্ঘ দশ বছর ডিরেক্টরের পদে ছিলেন তিনি।
ভারতীয় শিল্পকে, পুরাতত্ত্বকে, সর্বোপরী সার্বিক ভারতীয় সভ্যতাকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরার কাজ করে গেছেন সারা জীবন। আজকের আধুনিক সময়ের ভারত রাষ্ট্র নয়, ভারতীয় সভ্যতাকে তিনি দেখতে পেয়েছেন অনেক বিস্তৃত পরিসরে। হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন এবং আরব-পারস্যের মূর্তিশিল্প, লিপি-সূত্রের মধ্যে তিনি গভীর সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন এবং নিজের ছাত্রদের কাছে, সারা পৃথিবীর কাছে তা তুলে ধরেছেন। আসলে আমাদের ঐতিহ্যকে শুধু আজকের সীমানার মধ্যে খুঁজলে হবে না, এর পরিধি, ব্যাপ্তি অনেক বড়। অনেক বিস্তৃত। এটা তিনি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন জীবনভর।
পারিবারিক জীবনে বাবা ছিলেন আমাদের ছত্রধর। তবে শুধু আমরাই নই, বহু মানুষের সুখে দুঃখে সময়ে অসময়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন। দীর্ঘ জীবনের অধিকারী ছিলেন। সেই জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে সমৄদ্ধ করেছেন নিজের কাজের মাধ্যমে। দেশ বিদেশে বাবার খ্যাতি ছিল অগাধ পাণ্ডিত্যের জন্য। বাবার শ্রাদ্ধের দিন টেবিল সাজিয়েছিলাম বাবার লেখা বই দিয়ে। বড় টেবিল, কিন্তু জায়গা হয়নি সব বইয়ের। জায়গা হয়নি বাবার পাওয়া সব সম্মানপত্রেরও। বাবার সযত্নে রাখা বই, কাগজপত্রের মধ্যে থেকে ক্রমশ প্রকাশ পেয়েছে শয়ে শয়ে লেখা। বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরের জার্নাল, বই, মোনোগ্রাফ ইত্যাদিতে।
বাবা ভারত সরকারের উচ্চপদস্থ দায়িত্বশীল কর্মী ছিলেন। ভারতবর্ষের কলা, সংস্কৄতি, ইতিহাসকে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে দেওয়া তাঁর দায়িত্ব ছিল। ভারতীয় জাদুঘরের অধিকর্তা হিসাবে বহু গ্যালারি নিজের হাতে তৈরি করেছেন। বহু দেশ ঘুরেছেন কর্মসূত্রে। দেশে এবং বিদেশে বক্তৃতা দিতে আমন্ত্রিত হয়েছেন। সম্মানিত হয়েছেন। কাজ করেছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী, গভর্নর, আমলা, বিদ্বদ্জ্জনদের সঙ্গে। বহু লোকের স্নেহভাজন হয়েছেন।
আরও পড়ুন: একসঙ্গে ১০টি নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড জুড়ে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ল চিন! কীসের ইঙ্গিত?
১১ জুন ২০১৬ বাবা চলে গেলেন। তার কয়েক ঘণ্টা আগেও দিদি ফোনে বলেছে বাবা ঘুমোচ্ছেন। যে রকম ঠিক করা আছে, ক’দিন পরেই কলকাতা যাব। কানাডার ঘড়িতে তখন রাত ৯টা। ফোন বেজে উঠল, দেখি মা’র নম্বর। ওপারে দিদির গলা- "চলে আয়, বাবা ভাল নেই।" আমি কিছু বলার আগেই ভিতর থেকে ভেসে এল সেই চরম দুঃসহনীয় দুঃসংবাদ। বাবা নেই। পৃথিবীটা মুহূর্তের মধ্যে শূন্য হয়ে গেল।ঘটনার আকস্মিকতায় আমি তখন পাথর হয়ে গেছি।
ভারত সরকার মৃত্যুর পর তাঁকে পদ্মশ্রী দিয়ে সম্মানিত করেছে। মেয়ে হিসেবে আমার কাছে, আমাদের গোটা পরিবারের কাছেই এটা গৌরবের। তবু প্রথমেই যা বলছিলাম, একটা আক্ষেপ রয়ে গেল, খবরটা যদি বাবা পেয়ে যেতে পারতেন...।