Advertisement
১৯ মে ২০২৪

পানশালার ডান্স ফ্লোর রঙিন করে সিন্ডিকেটের কাঁচা টাকা

রাত ১১টা নাগাদ ঢুকলেন চার যুবক। উচ্চগ্রামে বাজছে চটুল হিন্দি গান।ঝলমলে রঙিন আলোর নীচে গানের তালে শরীর দোলাচ্ছেন দুই নর্তকী। সামনেই সোফা। রাজারহাটের পানশালায় তখন নেশায় নেশায় রাত বাড়ছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে যুবকের দল। কেউ পকেট থেকে টাকা বের করে দূর থেকে দেখাচ্ছেন নর্তকীদের। নাচতে নাচতে এগিয়ে আসছেন নর্তকীরা। টাকা নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন ফ্লোরে। তখনই চার যুবক এসে সোজা গিয়ে সোফায় বসলেন। যুবকদের কারও দু’হাতের প্রায় প্রতি আঙুলেই সোনার আংটি। কারও হাতে সোনার ব্রেসলেট। সঙ্গে ষোলো আনা জমিদারি মেজাজ।

প্রবাল গঙ্গোপাধ্যায়
ভিআইপি রোড শেষ আপডেট: ২০ মার্চ ২০১৬ ০১:২৭
Share: Save:

রাত ১১টা নাগাদ ঢুকলেন চার যুবক। উচ্চগ্রামে বাজছে চটুল হিন্দি গান।ঝলমলে রঙিন আলোর নীচে গানের তালে শরীর দোলাচ্ছেন দুই নর্তকী। সামনেই সোফা। রাজারহাটের পানশালায় তখন নেশায় নেশায় রাত বাড়ছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে যুবকের দল। কেউ পকেট থেকে টাকা বের করে দূর থেকে দেখাচ্ছেন নর্তকীদের। নাচতে নাচতে এগিয়ে আসছেন নর্তকীরা। টাকা নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন ফ্লোরে। তখনই চার যুবক এসে সোজা গিয়ে সোফায় বসলেন। যুবকদের কারও দু’হাতের প্রায় প্রতি আঙুলেই সোনার আংটি। কারও হাতে সোনার ব্রেসলেট। সঙ্গে ষোলো আনা জমিদারি মেজাজ।

পানশালার ‘ডান্স ফ্লোরের’ একেবারে সামনে বসে কিছুক্ষণ বাদে বাদেই ওই যুবকেরা নর্তকীদের দিকে কড়কড়ে টাকার নোট দেখানো শুরু করলেন। চকচকে ১০ টাকা, ২০ টাকা, ৫০ টাকার নোটের বান্ডিল বাঁ হাতে উঁচু করে ধরে, ডান হাতের তর্জনীর অদ্ভুত কায়দায় নোটগুলো ওড়াতে শুরু করে দিলেন তাঁরা। হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে সেই নোট ছড়িয়ে পড়ছিল নর্তকীদের পায়ের কাছে, পানশালার ডান্স ফ্লোরে। কখনও নর্তকীরা নিজে, কখনও আবার তাঁদের সহযোগীরা সেই টাকা
কুড়িয়ে নিচ্ছিলেন।

কোথা থেকে আসছে এত টাকা?

রাজারহাট-নিউ টাউন, দমদম, বাগুইআটি, বিমানবন্দর এলাকা থেকে তোলা সিন্ডিকেটের কাঁচা টাকার খোঁজে ঘুরতে ঘুরতে জানা গিয়েছিল এই পানশালার কথা। পুলিশেরই এক সূত্র জানিয়েছিলেন, সিন্ডিকেট থেকে উঠে আসা টাকা এখন মূলত বিনিয়োগ করা হচ্ছে পানশালায়। আর তাই, গত কয়েক বছরে এই সব এলাকায় একের পর এক পানশালা গজিয়ে উঠেছে।

উঠে আসছে শাসক দলের নেতা-নেত্রীর নামও। জানা যাচ্ছে, নেতা-নেত্রীদের যে ঘনিষ্ঠ শাগরেদরা এখন ওই এলাকায় সিন্ডিকেটের ব্যবসা করছেন, তাঁরাই নিয়ন্ত্রণ করেন পানশালাগুলি। বাগুইআটিতে দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কারণে সম্প্রতি খুন হয়ে যাওয়া সঞ্জয় রায় ওরফে বুড়োর নামও ছিল তালিকায়। পুলিশের সন্দেহ, স্থানীয় পানশালায় টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন বুড়ো। তাঁর খুনের পিছনেও ছিল ওই টাকার ভাগ-বাঁটোয়ারা সংক্রান্ত গণ্ডগোল।

উঠে এসেছে তৃণমূলের এক মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ এক যুব-নেতার নামও। এক সময়ে বুড়োকে নিয়ন্ত্রণ করতেন এই যুবকই। তাঁকে বিধাননগর পুর-নির্বাচনে ওই এলাকা থেকে নির্বাচনের টিকিট দেওয়ার জন্য তদ্বির করেছিলেন দলেরই এক নেতা ও নেত্রী। কিন্তু, সেই নাম বাতিল করে দেয় শীর্ষ নেতৃত্ব। সেই যুবকও যে পানশালায় নিয়মিত টাকা বিনিয়োগ করেন, সে প্রমাণও রয়েছে পুলিশের কাছে।

পুলিশই জানাচ্ছে, সিন্ডিকেট ও পানশালার এই কারবার একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠছে। তবে, সিন্ডিকেটের কারবারিরা কখনই সরাসরি নিজের নামে টাকা বিনিয়োগ করেন না। সামনে রাখা হয় ব্যান্ড লিডারদের। যাঁরা ডিজে-নর্তকীদের যোগাড় করে আনেন। ডান্স ফ্লোর সংক্রান্ত কোনও সমস্যা হলে এই আপাত নিরীহ ব্যান্ড লিডারদেরই পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। পর্দার আড়ালে থেকে যান সিন্ডিকেটের কারবারিরা।

জানা গিয়েছে, সিন্ডিকেটের যুবকদের মধ্যে এক দল রয়েছেন, যাঁরা টাকা বিনিয়োগ করেন। আর এক দল শুধু টাকা ওড়াতেই আসেন। এক পানশালাকর্মীর কথায়, ‘‘প্রতি রাতে হাজার হাজার টাকার খুচরো নোট উড়ে বেড়ায়। পানশালা বন্ধ করার পরে সেই টাকা তুলে রাখা হয়। পরের রাতে যখন খদ্দের আসে, বড় নোট দিয়ে এই খুচরো নিয়ে নেন। আবার শুরু হয় টাকা ওড়ানোর খেলা।’’

এ এক নেশার মতো। পানশালা সূত্রেই জানা গিয়েছে, প্রতি রাতে এক একটি পানশালায় এ ভাবে আঙুলের ছোঁয়ায় উড়ে যায় লক্ষ টাকার কাছাকাছি। বাগুইআটি, রাজারহাট জুড়ে যে নির্মাণ ব্যবসা, সেখানে প্রোমোটারদের ভয় দেখিয়ে, জুলুম করে তোলা হয় এই টাকা। চড়া দামে বালি-পাথর কিনতে বাধ্য করা হয়। ইদানীং আবার নতুন ‘তালাচাবি’ ব্যবস্থায় প্রোমোটরদের কাছ থেকে জমি, নকশা, টাকা নিয়ে নিজেরাই বাড়ি বানাচ্ছেন সিন্ডিকেটের যুবকেরা। কাঁচা টাকায় বদলে যাচ্ছে জীবনযাত্রার ছবিটাই। দামি গাড়ি, মোটরবাইক, পোশাক, বিমানে করে বেড়়ানো। সঙ্গে রয়েছে নেশাতুর রাত, নর্তকী এবং পানশালার আড়ালে রমরমিয়ে চলা দেহ-ব্যবসা।

পুলিশের একাংশ জানান, এ সবই নিয়ন্ত্রণ করেন সিন্ডিকেটের যুবকেরা। পানশালার মালিকেরা ‘ডান্স ফ্লোর’ আলাদা করে ভাড়া দিয়ে দেন। পুলিশ জানিয়েছে, সিন্ডিকেটের যুবকেরাই মূলত সেই ডান্স ফ্লোর ভাড়া নেন। তাঁরাই নর্তকী-ডিজে ঠিক করেন। রাত গভীর হলে সেই ডান্স ফ্লোর, দেহ ব্যবসা থেকে বিনিয়োগ করা টাকার কয়েক গুণ বেশি লাভ উঠে আসে।স্বভাবতই এত লাভ দেখে তার দিকে নজর পড়েছে রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদেরও। তাঁরাও অনেক ক্ষেত্রে সরাসরি নেমে পড়ছেন বিনিয়োগে। নেতা নেত্রীদের নিজস্ব পেটোয়া সিন্ডিকেট রয়েছে। তা মারফত নেতা-নেত্রীরা নিজের নিজের এলাকায় ‘ডান্স ফ্লোর’ ব্যবসায় টাকা ঢালছেন। তবে, সবটাই বেনামে। এ ক্ষেত্রেও সামনে রাখা হয় ওই ব্যান্ড লিডারদেরই।

পুলিশের দাবি, সিমেন্ট, বালির সিন্ডিকেটের চেয়েও এই পানশালা সিন্ডিকেট আরও বড়। যেখানে রাজনীতিক, সিন্ডিকেট ব্যবসায়ী, দুষ্কৃতী আর পানশালার মালিক একযোগে জড়িত। এক সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীর কথায়, ‘‘এক গাড়ি পাথর বা বালি প্রোমোটারকে চড়া দামে বিক্রি করে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা লাভ থাকে। ফলে পানশালায় টাকা ঢালতে অসুবিধা হয় না। সেই টাকা আবার কয়েক গুণ বেড়ে যায় পানশালার ফ্লোরে।’’

সূত্রের খবর, এতে সুবিধা পাচ্ছেন পানশালার মালিকেরাও। নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে গভীর রাত পর্যন্ত সুর আর সুরার এই খেলায় প্রত্যক্ষ সমর্থন আসছে সিন্ডিকেট ও রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে। ফলে, চোখের সামনে সব কিছু দেখে চোখ বুঝে বসে থাকা ছাড়া পুলিশেরও কোনও উপায় নেই। ভাগের কিছু টাকাও উড়ো খইয়ের মতো তাঁদের দরজার সামনে এসেও পড়ছে।

গত বছর বিধাননগরের পুলিশ কমিশনার জাভেদ শামিমের নির্দেশে একাধিক বার ওই সব পানশালায় হানা দিয়েছে পুলিশ। কয়েক বার একাধিক মহিলাকে উদ্ধারও করেছে। পানশালার ‘দুঃসাহসী’ মালিকেরা পুলিশের গায়ে হাত তুলেও ছাড়া পেয়ে গিয়েছেন। পুলিশের দাবি, মহিলা পাচারকারী কয়েক জনকে এলাকা ছাড়া করে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। দেহ ব্যবসা আটকাতে পানশালাগুলিতে নাচগান বন্ধও করে দিয়েছিল পুলিশ। পানশালার মালিকেরা আদালতের দ্বারস্থ হলে শাসক দলের আইনজীবী নেতাই পানশালা মালিকদের হয়ে মামলা লড়েন। শেষ পর্যন্ত মামলা হেরে যায় পুলিশ।

বিধাননগর পুলিশের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘‘আদালত কিছু শর্ত দিয়েছিল পানশালাগুলিতে। তার কিছুই মানা হয় না। শুনেছি, আবগারি দফতর নাকি পানশালার ভিতরে নজরদারি চালায়।’’

পুলিশ রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে।

অঙ্কন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

syndicate viproad
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE