নিজেদের করুণ দশায় রসিকতা করছেন প্রবীণ মফিজর রহমান।
‘‘টেক টেক। নো টেক, নো টেক! এক বার তো সি।’’ সাহেবি আমলে এ ভাবেই নিউ মার্কেটে মেমসাহেবদের কেক কিনতে ডাকতেন আনপড় বেকারি-কর্মীরা। এ বছর যা দিনকাল, তাতে কেকের মালমশলা কিনতেই ফের মহাজনের পায়ে মাথা খুঁড়তে হচ্ছে। বড়দিনের শহর তার বচ্ছরকার কেক-পার্বণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, এখনও বলা যাচ্ছে না। তবে নগদের আকালে কেকের পসরা সাজানোর পথটাই কাঁটায় ছয়লাপ।
বৌবাজারের ওয়েস্টন স্ট্রিটে শতক-পেরনো সাবেক বেকারির দোকান-কাম-কারখানায় ঢুকেই অবস্থাটা মালুম হবে। প্রকাণ্ড আভেনের চুল্লিতে কাঠকয়লার আঁচ তৈরি। পেল্লায় ডেকচিতে মাখন-ময়দা-মোরব্বার খামির। কিন্তু ‘ফয়েল’ কোথায়? আগে অ্যালুমিনিয়ামের ফয়েলে ভরা খামির বেক হয়ে ‘প্যাক’ হয়েই আভেন থেকে কেক রূপে বেরোত। এখন ফয়েল, প্যাকিং কোনওটাই নেই। আজমিরি বেকারির হবিবর রহমান বললেন, ‘‘ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের ফয়েল কারখানা অত ফয়েল দিতে পারছে না। ‘টিনের ছাঁচা’য় বেক করতে হচ্ছে। ট্রেসিং পেপারে মুড়ে কেক দিচ্ছি। প্যাকিংয়ের বাড়তি হাঙ্গামায় ডবল লেবার লাগছে।’’
গোটা সমস্যার নেপথ্যে ভিলেন সেই নোটের আকাল। ফয়েল কারখানা নাকি লেবারদের নগদ দিতে পারছে না। কেকের ফয়েল জুটছে না। মেজ-ছোট বহু বেকারিই এই সমস্যায় ভুগছে এখন।
মহাজনের থেকে মোরব্বা, চেরি, ময়দা বাকিতে নিতেও বাড়তি টাকা গচ্চা দিতে হচ্ছে। বেলেঘাটার মোরব্বার কারবারি বলে দিয়েছেন ৬০-৬৫ টাকা কেজির মোরব্বা ধারে নিলে ৯০ টাকা পড়বে। বারুইপুরের চেরির দাম কেজি প্রতি ৮০ টাকা থেকে বেড়ে ১৩০ টাকা। ময়দাও বস্তা পিছু বাড়তি ১০০-১৫০ টাকা গুনতে হচ্ছে। সর্বত্র রীতিমতো চড়া দরের ‘ক্যাশলেস রেট’।
হবিবর বলছিলেন, ‘‘গণেশ অ্যাভিনিউয়ে হোটেল কেকের দাম চেকে দিচ্ছে। অথচ কেকের মালমশলা বাকিতে কিনতে হিমশিম।’’ নগদ জোগাড় করতে এক-একটি বেকারি চার-পাঁচ জন বাড়তি লেবার কাজে লাগিয়েছে। এক জন ব্যাঙ্কে। এক জন টাকা নিয়ে মহাজনের দরবারে। বেশির ভাগ বেকারি-মালিকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টই হুগলির কোনও শাখায়। তাতেও ভোগান্তি।
ইদানীং হরেক কিসিমের শৌখিন কেকের ঝোঁক বেড়েছে কলকাতায়। তবে আম নাগরিকদের ঢালাও কেকের জোগান দিতে সাবেক বেকারিই ভরসা। তাদের চোদ্দ আনাই আরামবাগের লোকজনে ভরপুর। পুড়শুড়ার দর্জি মকিতুর রহমান, বিরিয়ানির ‘মিস্ত্রি’ রমজান আলি, এসি দোকানের কর্মচারী রবিউর দেওয়ানরা আপাতত বেকারি-শ্রমিক। প্রায় ২৪ ঘণ্টা ডিউটি করছেন। তাঁরাও জানেন না, মালিক কবে নগদে টাকা দিতে পারবেন।
হাওড়ার ওরিয়েন্ট, অম্বিকা, তালতলার ডালিয়া থেকে রাজাবাজারের সরকার বেকারি— সর্বত্রই দুশ্চিন্তার আবহ। হারুন সরকার, আশরফ মোল্লারা বছরভর বিস্কুট-নানখাটাই নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। বচ্ছরকার কেকের জন্য মাঠে নামেন বাড়তি লোক লাগিয়ে। বৌবাজারের বেকারিতে ক্রিসমাস ইভে সাধারণত ২০-২৫ হাজার কেক বিক্রি হয়। এ বছরও সেই চাহিদার কথা ভেবেই লড়াই চলছে। কিন্তু শেষমেশ কেকের মেওয়া কতটা ফলবে, সেটাই অনিশ্চিত।