Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

ভরসন্ধ্যায় দোকানে খুন ব্যবসায়ী

গাড়ির চালককে তিনি বলেছিলেন, ফিরতে দেরি হবে। তাই অন্য দিনের তুলনায় বেশ কিছু ক্ষণ দেরিতে আসেন চালক। এসে দেখেন, দোকানের শাটার বন্ধ। কিন্তু তালা লাগানো নেই। সন্দেহ হতেই শাটার খুলে দোকানে ঢুকে তিনি দেখেন, মেঝেতে পড়ে রয়েছেন মনিব।

মহম্মদ সেলিম।

মহম্মদ সেলিম।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০১৭ ০২:২৩
Share: Save:

গাড়ির চালককে তিনি বলেছিলেন, ফিরতে দেরি হবে। তাই অন্য দিনের তুলনায় বেশ কিছু ক্ষণ দেরিতে আসেন চালক। এসে দেখেন, দোকানের শাটার বন্ধ। কিন্তু তালা লাগানো নেই। সন্দেহ হতেই শাটার খুলে দোকানে ঢুকে তিনি দেখেন, মেঝেতে পড়ে রয়েছেন মনিব। মুখে জড়ানো লিউকোপ্লাস্ট। গলায় দড়ির ফাঁস।

সোমবার রাতে এ ভাবেই নিজের দোকানে খুন হয়ে গিয়েছেন জাকারিয়া স্ট্রিটের জহুরি বাজারের ব্যবসায়ী মহম্মদ সেলিম (৫৫)। কারা কী কারণে তাঁকে খুন করল, তা নিয়ে ধন্দে তদন্তকারীরা। রাতেই সেলিমের গাড়ির চালক মহম্মদ ইলিয়াসকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে জোড়াসাঁকো থানার পুলিশ। ঘটনাস্থলে তদন্তে আসেন কলকাতা পুলিশের ফিঙ্গার প্রিন্ট বিশেষজ্ঞেরা এবং ডগ স্কোয়াড।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, রাজাবাজারের ওরিয়েন্টাল আবাসনের বাসিন্দা সেলিম বিভিন্ন ধরনের পাথরের ব্যবসা করতেন। জহুরি বাজারেই রয়েছে তাঁর দোকান। তবে সেলিমের কোনও কর্মচারী ছিলেন না। একাই ব্যবসা সামলাতেন তিনি। প্রতিদিন বেলা ১১টা নাগাদ বাড়ির গাড়িতে চেপেই দোকানে আসতেন সেলিম। তার পরে গা়ড়ি নিয়ে রাজাবাজারে ফিরে যেতেন ইলিয়াস। পরে রাত আটটা নাগাদ তিনি জহুরি বাজারে চলে আসতেন মনিব সেলিমকে নিতে।

দোকানের সামনে জমেছে ভিড়। মঙ্গলবার জাকারিয়া স্ট্রিটে। —নিজস্ব চিত্র

চালক ইলিয়াস পুলিশের কাছে দাবি করেছেন, ওই দিন রাত আটটা নাগাদ তিনি ফোন করেছিলেন সেলিমকে। সেলিম তাঁকে জানিয়েছিলেন, কিছু কাজ রয়েছে, তাই ফিরতে রাত ন’টা বেজে যাবে। ইলিয়াসের আরও দাবি, সেই মতো তিনি রাত দশটা নাগাদ জাকারিয়া স্ট্রিটে আসেন। তখন সেলিমের স্ত্রী ফোন করে ইলিয়াসকে জানান, সেলিমকে তিনি ফোন করে পাচ্ছেন না। ইলিয়াসের দাবি, তিনিও বারবার সেলিমকে ফোন করার চেষ্টা করেন। কিন্তু নেটওয়ার্ক না থাকায় সংযোগ হয়নি।

পুলিশ সূত্রের খবর, সেলিমের দোকান ‘এস এন অম্বর জুয়েলার্স’-এর সামনে এসে ইলিয়াস দেখেন, শাটার নামানো। কিন্তু তালা দেওয়া নেই। ইলিয়াস শাটার খুলে দোকানে ঢোকেন। তাঁর দাবি, দোকানের সামনের অংশের আলো বন্ধ ছিল। তবে ভিতরে যে ‘অ্যান্টি চেম্বার’ রয়েছে, সেখানে আলো জ্বলছিল। ইলিয়াস ঢুকে দেখেন, মাটিতে চিৎ হয়ে পড়ে রয়েছেন সেলিম। মুখের লিউকোপ্লাস্ট খুলে মনিবের চোখেমুখে জল ছেটান ইলিয়াস। কিন্তু বারবার ঝাঁকানোর পরেও কোনও সাড়া না মেলায় তিনি আশপাশের দোকানিদের খবর দেন। ফোন করেন সেলিমের স্ত্রী ও ভাই নাসিমকে। খবর পেয়ে চলে আসেন স্থানীয় থানার অফিসার ও কলকাতা পুলিশের পদস্থ কর্তারা।

মর্মান্তিক: দোকানের ভিতর পড়ে রয়েছে মহম্মদ সেলিমের দেহ।

জাকারিয়া স্ট্রিটের জহুরি বাজারের ব্যবসায়ী সমিতির যুগ্ম সম্পাদক মহম্মদ আসলাম বলেন, ‘‘দোকানের সামনে শো-কেসের ভিতরে যে সমস্ত নকল পাথর ছিল, সেগুলি সবই নিয়ে গিয়েছে দুষ্কৃতীরা।’’ পুলিশ জানিয়েছে, হানাদারেরা দোকানের নকল হিরে ছাড়াও সিন্দুক খুলে তিনটি আসল হিরে ও প্রায় এক লক্ষ নগদ টাকা নিয়ে পালিয়েছে। সেলিমের হাতে দামি পাথরের দু’টি আংটি ছিল। তার একটি এবং সেলিমের মোবাইল ফোনটিও নিয়ে গিয়েছে তারা। তদন্তকারীদের অনুমান, আততায়ীরা সংখ্যায় দু’তিন জন ছিল। তাদের সঙ্গে সেলিমের রীতিমতো ধস্তাধস্তি হয়েছিল বলেও অনুমান পুলিশের। কারণ, যে জায়গায় তিনি পড়ে ছিলেন, সেখানেই মিলেছে জামার একটি ছেঁড়া বোতাম। তদন্তকারীদের অনুমান, আততায়ীরা বেশ কিছু দিন ধরে ‘রেকি’ করার পরেই এসেছিল। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য কি নিছক ডাকাতি, না অন্য কিছু? এটাই আপাতত ভাবাচ্ছে পুলিশকর্তাদের। কারণ, শুধু লুঠপাটই উদ্দেশ্য হলে আততায়ীরা নকল পাথর নিয়ে যাবে কেন? পুলিশের ধারণা, দুষ্কৃতীদের সেলিম চিনতেন। না-হলে তাদের অ্যান্টি চেম্বারে নিয়ে যেতেন না।

জাকারিয়া স্ট্রিটের ওই বাজারে কোনও সিসিটিভি নেই। তাই কে বা কারা ওই সময়ে ঢুকেছিল, তা জানা সহজ হবে না বলেই দাবি পুলিশের। কিন্তু আশপাশের দোকানিরা কিছু বুঝতে পারলেন না কেন? ব্যবসায়ী সমিতির সদস্য পারভেজ আলম বলেন, ‘‘প্রতিদিনই সাড়ে সাতটা থেকে আটটার মধ্যে অধিকাংশ দোকান বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু সেলিম নমাজ পড়ে তবেই দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরতেন। ওঁর মতো ভাল মানুষ কমই হয়।’’

ওই রাতেই পুলিশের কুকুরকে ঘটনাস্থলে আনা হয়। দোকান থেকে বেরিয়ে সে প্রথমে জাকারিয়া স্ট্রিটে ঘোরাঘুরি করার পরে সোজা রবীন্দ্র সরণির ট্রামলাইনে চলে যায়। সেখান থেকে সোজা রাস্তার উল্টো দিকের একটি বাজারে ঢুকে পড়ে। বেশ কয়েক বার ওই বাজারে ঢোকে কুকুরটি। তদন্তকারীদের ধারণা, ওই বাজারের ভিড়ে মিশেই চম্পট দিয়েছে দুষ্কৃতীরা।

প্রশ্ন যেখানে


চার দিন আগে আসানসোলের ওই ক্রেতারা দোকানে এসেছিলেন। তখন কি কেউ দেখেছিল?


এত ব্যস্ত রাস্তায় ঘটনার চার ঘণ্টা পরে কুকুর নিয়ে গিয়ে কি কোনও লাভ হয়?


সেলিমের দোকানে পাওয়া যাওয়া বোতাম কার?


খুনিরা খুব পরিচিত না হলে কি তাঁদের সেলিম অ্যান্টিচেম্বারে নিয়ে যেতেন?


অ্যান্টিচেম্বারে ধস্তাধস্তির চিহ্ন স্পষ্ট। আলমারির কাচও ভাঙা। সেলিমের গায়ে আঁচড়ের দাগও রয়েছে। ভিতরের এত সব হল কিন্তু শব্দ বাইরে এল না কেন?


দুষ্কৃতীরা সেলিমের মোবাইল ফোনটাই বা নিয়ে গেল কেন?

পুলিশ জানিয়েছে, স্ত্রীকে নিয়ে রাজাবাজারের একটি বহুতলের পাঁচতলার ফ্ল্যাটে থাকতেন নিঃসন্তান সেলিম। মঙ্গলবার ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, প্রৌঢ়া স্ত্রী শগুফতা ইয়াসমিন কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। ফ্ল্যাটের নিরাপত্তারক্ষী থেকে বাসিন্দা, প্রত্যেকের মুখে একটাই কথা, ‘‘সেলিম সাহেব খুব ভাল মানুষ ছিলেন। ওঁর সঙ্গে কারও শত্রুতা ছিল না।’’ মৃতের ভাই জামিল আখতার বলেন, ‘‘গত কাল বাড়িতে ফোন করে দাদা বলেছিলেন, আসানসোল থেকে এক নতুন খদ্দের আসবেন। তাই তাঁর ফিরতে একটু রাত হবে। তিন-চার দিন আগেও এক বার ওই খদ্দের এসেছিলেন বলে দাদা জানিয়েছিলেন।’’ মৃতের খোয়া যাওয়া মোবাইলের সূত্র ধরে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। এই ঘটনায় মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত কেউ গ্রেফতার হয়নি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE