Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

নকল পা সরিয়ে এক পায়েই নাচ অঞ্জলির

সে বলেছিল, ‘যে ভাবে হোক কাঠের পা জোগাড় করে নাচটা চালিয়ে যাব।’ একটি বেসরকারি সংগঠনের সহায়তায় কাঠের পা জুটল ঠিকই, কিন্তু সেই পায়ে শুধু চলাফেরা করা যায়।

দৃঢ়প্রতিজ্ঞ: কৃত্রিম পা খোলা রয়েছে পাশে। এক পায়েই অনুশীলন অঞ্জলির। ছবি: শশাঙ্ক মণ্ডল

দৃঢ়প্রতিজ্ঞ: কৃত্রিম পা খোলা রয়েছে পাশে। এক পায়েই অনুশীলন অঞ্জলির। ছবি: শশাঙ্ক মণ্ডল

সোমা মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২০১৮ ০১:৪৯
Share: Save:

ছোট থেকেই নাচত মেয়েটা। পাড়ায়, স্কুলে নাচের অনুষ্ঠানে পুরস্কার প্রায় বাঁধা ছিল তার। তাই চার বছর আগে যখন ক্যানসারে তারই একটি পা বাদ গেল, চারপাশে সকলেই ভেঙে পড়েছিলেন। কিন্তু সেই মেয়ে অর্থাৎ, অঞ্জলি ভেঙে পড়েনি। সে বলেছিল, ‘যে ভাবে হোক কাঠের পা জোগাড় করে নাচটা চালিয়ে যাব।’ একটি বেসরকারি সংগঠনের সহায়তায় কাঠের পা জুটল ঠিকই, কিন্তু সেই পায়ে শুধু চলাফেরা করা যায়। নাচা যায় না। নাচ চালিয়ে যাওয়ার জন্য যে ধরনের কৃত্রিম অঙ্গ প্রয়োজন হয়, তা খুবই ব্যয়সাপেক্ষ। অঞ্জলির বাবা-মা ভেবেছিলেন, নাচ না হয় না হোক, মেয়েটা স্বাভাবিক ভাবে হেঁটেচলে বেড়াতে পারবে, এই ঢের। অঞ্জলি অবশ্য সেটা ভাবেনি।

কাঠের পা খুলে রেখে এক পায়ে নাচার চেষ্টা শুরু করেছিল সে। পারত না। বারবার মুখ থুবড়ে পড়ে যেত। কোনও কিছুতে ভর দিয়ে আবার উঠে দাঁড়াত। টানা চার বছরের চেষ্টার পরে এখন এক পায়েই দুরন্ত গতিতে নাচছে সুভাষগ্রামের ওই কিশোরী। আগামী সপ্তাহে কলকাতায় প্রথম বড় মঞ্চে তার অনুষ্ঠান।

অঞ্জলির নাচের শিক্ষক কুন্তল বর্ধন জানান, তিনি যখন অঞ্জলিকে প্রথম দেখেন তখন ওর বাঁ পায়ের জায়গায় শুধু একটা মাংসের দলা। তিনি বলেন, ‘‘আমি ওকে সুধা চন্দ্রনের নাচের সিডি দেখিয়েছিলাম। বলেছিলাম, উনি কাঠের পায়ে নাচেন। কিন্তু তুমি এক পায়েই নাচবে। সেখানেই তুমি সকলের থেকে আলাদা হবে।’’ সেই কথাটাকেই জীবনের মন্ত্র করে নিয়েছিল ওই কিশোরী। চারপাশে সকলে যখন বিশ্বাস করত, তার নাচ বাকি জীবনের জন্য বন্ধ হয়ে গেল, তখন একমাত্র সে নিজেই নিজের সংকল্পে স্থির ছিল।

অঞ্জলি জানায়, সে সুধা চন্দ্রনের কথা শুনেছে। পেশায় নার্স, ২৭ বছরের সুভ্রিত কৌর ঘুম্মন ২০০৯ সালে এক দুর্ঘটনায় তাঁর একটি পা হারিয়েছিলেন, শুনেছে তাঁর কথাও। সেই সুভ্রিত এখন এক পায়ে নাচছেন। তবে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, অঞ্জলির পা বাদ গিয়েছে ক্যানসারে, কোনও দুর্ঘটনায় নয়। বাকিদের থেকে আর্থ-সামাজিক ভাবে তার অবস্থানটাও আলাদা। তাই তার লড়াইটাও আলাদা।

আরও পড়ুন: ‘সম্পত্তি হাতাতে’ দিদিকে মার, ত্রাতা পড়শিরা

সুভাষগ্রাম নবতারা বিদ্যালয়ের এই ছাত্রী শৈশবে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়। চিকিৎসা পরিভাষায় এর নাম অস্টিওসার্কোমা। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, হাড়ের এক ধরনের টিউমারকে অস্টিওসার্কোমা বলা হয়। সাধারণ ভাবে শিশু ও কিশোর-কিশোরীরাই এই রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। অঞ্জলির ক্ষেত্রে দীর্ঘ চিকিৎসায় তার ক্যানসার সারল ঠিকই, কিন্তু একটা পা কুঁচকি থেকে বাদ দিতে হল। অসুখের জন্য টানা দু’বছর বন্ধ রইল পড়াশোনাও।

যে বেসরকারি সংগঠন অঞ্জলিকে নানা ভাবে সাহায্য করেছে তাদের তরফে পার্থ সরকার বলেন, ‘‘অঞ্জলির ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পটাই আমরা সকলের সামনে তুলে ধরতে চাই। ক্যানসার, তার জেরে অঙ্গহানি, কোনওটার অর্থই যে জীবন শেষ হয়ে যাওয়া নয়, তার পরেও যে একটা সুন্দর জীবন অপেক্ষা করতে পারে, সেটা মানুষকে জানানোই আমাদের লক্ষ্য।’’

সব বিপর্যয় কাটিয়ে উঠে আবার স্কুলে যাচ্ছে অঞ্জলি। সে এখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। বাবা পোশাকের কারখানায় সামান্য বেতনে কাজ করেন। মা গৃহবধূ। ভাই সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। অঞ্জলি বলে, ‘‘লেখাপড়াটা অনেক দূর চালাতে চাই। তবে আমার কাছে সবচেয়ে আগে নাচ। ভবিষ্যতে নাচকেই পেশা করতে চাই। সংসারের দায়িত্ব নিতে চাই।’’ বয়সের তুলনায় অনেক বেশি পরিণত শোনায় তার গলা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE