Advertisement
০৬ মে ২০২৪

বিষ-জল খাচ্ছে শহর, তবু নির্বিকার পুরসভা

কলকাতার ভূগর্ভস্থ জলস্তর ইতিমধ্যেই বিষাক্ত হয়ে গিয়েছে আর্সেনিক, লোহা ইত্যাদি উপাদানে। কিন্তু অভিযোগ, প্রতিক্রিয়া মারাত্মক জেনেও নাগরিকদের প্রতিদিন সেই বিষাক্ত জলই সরবরাহ করে চলেছে কলকাতা পুরসভা। কোনও হেলদোল নেই পুর-কর্তৃপক্ষের। মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় অবশ্য বিষাক্ত জল সরবরাহ করার অভিযোগ সরাসরি খারিজ করে দিয়েছেন।

প্রভাত ঘোষ
শেষ আপডেট: ১৪ মার্চ ২০১৫ ০০:২৩
Share: Save:

কলকাতার ভূগর্ভস্থ জলস্তর ইতিমধ্যেই বিষাক্ত হয়ে গিয়েছে আর্সেনিক, লোহা ইত্যাদি উপাদানে। কিন্তু অভিযোগ, প্রতিক্রিয়া মারাত্মক জেনেও নাগরিকদের প্রতিদিন সেই বিষাক্ত জলই সরবরাহ করে চলেছে কলকাতা পুরসভা। কোনও হেলদোল নেই পুর-কর্তৃপক্ষের। মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় অবশ্য বিষাক্ত জল সরবরাহ করার অভিযোগ সরাসরি খারিজ করে দিয়েছেন।

কলকাতা পুর-প্রশাসনের তরফে প্রায়ই দাবি করা হয়, শহরের অধিকাংশ ওয়ার্ডে গার্ডেনরিচ বা পলতার জল পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়। ফলে নাগরিকদের নলকূপের জল ব্যবহার করতে হয় না। প্রকৃত চিত্রটা অবশ্য অন্য। পুরসভার জল সরবরাহ দফতরের ডিরেক্টর জেনারেল বিভাস মাইতি স্বীকার করে নিয়েছেন, পলতা ও গার্ডেনরিচ থেকে শহরের প্রয়োজন পুরোপুরি মেটানোর জল পাওয়া যায় না। ফলে বিভিন্ন স্থানে একপ্রকার বাধ্য হয়েই গভীর নলকূপের জল মিশিয়ে শহরবাসীকে সরবরাহ করতে হয়।

সম্প্রতি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্কুল অব এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজ’ এবং তার পরে রাজ্য জল অনুসন্ধান দফতরের (স্যুইড) এক সমীক্ষায় ধরা পড়েছে, শহরে ভূগর্ভের জলস্তর আর্সেনিক, লোহা ইত্যাদি বিষাক্ত উপাদানের মিশ্রণে দূষিত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এই পরিস্থিতি জানা সত্ত্বেও কলকাতায় প্রতিদিন সরবরাহ করা ২৯ কোটি গ্যালন জলের একটা বড় অংশ তোলা হচ্ছে ৪১৭টি গভীর নলকূপ থেকে। পাশাপাশি, পুর এলাকায় ১২ হাজারেরও বেশি হস্তচালিত নলকূপের মাধ্যমে রোজ ভূগর্ভ থেকে জল তোলা হয় বলে জানিয়েছেন পুর-কর্তৃপক্ষ। তবে সেই জলের পরিমাণ কত, তার কোনও হিসেব পুরসভার কাছে নেই।

স্যুইড-এর সমীক্ষার রিপোর্ট নিয়ে সম্প্রতি বিধানসভার রাজ্য বাজেট অধিবেশনে বিবৃতি দিয়েছেন রাজ্যের জলসম্পদ উন্নয়ন ও অনুসন্ধান মন্ত্রী সৌমেন মহাপাত্র। ওই বিবৃতিতেও শহরের ভূগর্ভস্থ জলে অত্যধিক মাত্রায় আর্সেনিক থাকার কথা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ভূগর্ভস্থ জলে দূষণের মাত্রা এত বেশি জেনেও তা কেন রোজ সরবরাহ করা হচ্ছে? পুরসভার জল সরবরাহ দফতরের ডিজি বিভাস মাইতি বলেন, “বিপদ তো জানিই। কিন্তু কী করব? বিকল্প ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত এ ভাবেই জল সরবরাহ করতে হবে।” পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, বর্তমান তৃণমূল বোর্ড ক্ষমতায় আসার আগেই প্রাক্তন মেয়র বিকাশ ভট্টাচার্যের আমলে শহরে অধিকাংশ গভীর নলকূপ বসানো হয়েছিল এবং হস্তচালিত নলকূপ বসানোর অনুমতিও দেওয়া হয়েছিল। সেই ট্র্যাডিশন এখনও চলছে।

কিন্তু ভূগর্ভস্থ জলে কী কী বিষ মিশছে, সেই তথ্য জানেন না সাধারণ নাগরিকেরা। প্রশ্ন উঠেছে, জল পরীক্ষার রিপোর্ট প্রকাশ করা হয় না কেন? ‘অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব হাইজিন অ্যান্ড পাবলিক হেল্‌থ’-এর প্রাক্তন অধিকর্তা-অধ্যাপক অরুণাভ মজুমদার বলেন, “সংশ্লিষ্ট সব সরকারি দফতরই দাবি করে, শহর ও গ্রামের সব জায়গায় জল পরীক্ষার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু তার রিপোর্ট কখনও প্রকাশ করা হয় না। ফলে মানুষ জানতে পারেন না, তাঁরা যে জল খাচ্ছেন, তাতে জীবাণু-সহ অন্য ক্ষতিকর পদার্থ আছে কি নেই। যদি মানুষ না জেনে দূষিত জল পান করতে বাধ্য হন, সে ক্ষেত্রে সরবরাহকারীরা শাস্তিযোগ্য অপরাধ করছেন।”

কলকাতায় এই বিপদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বহুতল আবাসনগুলির বিপুল জলের প্রয়োজনীয়তা। জল-বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, শহরের ৯০ শতাংশ বহুতলই ভূগর্ভস্থ জল ব্যবহার করে। কারণ ওই ধরনের প্রতিটি আবাসনে জল সরবরাহ করতে গেলে পুরসভার তরফ থেকে ‘ডেডিকেটেড’ পাইপলাইন পাতার দরকার। অভিযোগ, কোনও ক্ষেত্রেই তা করা হয়নি। সাধারণ নিয়ম অনুসারে, বহুতল তৈরির সময়ে কাজের সুবিধার জন্য আবাসনের জমিতে গভীর নলকূপ খোঁড়ার অনুমতি দেয় সংশ্লিষ্ট পুরসভা। নিউ টাউনের ক্ষেত্রে সেই অনুমতি দেয় হিডকো। কিন্তু কলকাতা শহরে বহুতলের ক্ষেত্রে ছাড়পত্র নিতে হয় ‘স্টেট লেভেল স্কিম স্যাংশনিং কমিটি’র (এসএলএসএসসি) থেকে। ওই কমিটির একটি সূত্র জানিয়েছেন, নিউ টাউনে এমন কোনও অনুমতি নেওয়া হয়নি। এমনকী, কলকাতার ব্যাপারেও কমিটির কাছে এ নিয়ে কোনও আবেদন জমা পড়েনি।

এর পাশাপাশি নিয়ম রয়েছে, বহুতল তৈরি হয়ে গেলে ওই গভীর নলকূপ বন্ধ করে দিতে হবে। কিন্তু সেই নিয়মও মানা হয় না। আবাসন পর্ষদের একটি যৌথ সংস্থার এক শীর্ষ কর্তা বলেন, “পর্ষদের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে আমরা যে সব বহুতল আবাসন তৈরি করেছি, সেখানে গভীর নলকূপ খোঁড়ার পাশাপাশি জলের পাইপলাইন তৈরির কাজে প্রতিটি আবাসনের জন্য দুই থেকে আড়াই কোটি টাকা জমা দেওয়া হয়েছে পুরসভাকে। কিন্তু কোথাওই পাইপলাইনের ব্যবস্থা করা হয়নি। অগত্যা গভীর নলকূপের জলই সেখানকার বাসিন্দাদের ভরসা।”

শহরের ভূগর্ভস্থ জলে আর্সেনিকের আক্রমণ নিয়ে সম্প্রতি রাজ্য বাজেট অধিবেশনে বিবৃতি দেন রাজ্যের জলসম্পদ উন্নয়ন ও অনুসন্ধান মন্ত্রী সৌমেন মহাপাত্র। পরে তিনি জানান, কলকাতার পুর-কর্তৃপক্ষ বহুতল আবাসনগুলির অনুমতি দেওয়ার সময়ে যদি প্রাথমিক শর্ত হিসেবে বৃষ্টির জল ধরে রেখে বাধ্যতামূলক ভাবে আবার ব্যবহার করার বিষয়টি রাখতেন, তা হলে ভাল হত। কিন্তু সে দিকে কারও নজর নেই।

তবে মন্ত্রীর এই অভিযোগ সরাসরি অস্বীকার করেছেন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। তিনি জানিয়েছেন, কলকাতা পুরসভা গঙ্গার জল শোধন করে শহরের ৯৯.৯ শতাংশ এলাকায় বিশুদ্ধ পানীয় জল সরবরাহ করে। যদিও তাঁর জল দফতরই উল্টো হিসেব দিয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

prabhat ghosh arsenic underground water
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE