খুনিদের ধরার সূত্র বলতে কিছুই ছিল মেলেনি। না ছিল মোবাইল ফোনের কল ডিটেল রেকর্ড, না ছিল হাতিয়ার। ঘটনাস্থল কোথায়, কী কারণে খুন, তা নিয়েও পুলিশ ছিল সম্পূর্ণ অন্ধকারে। এমনকী, নিহতের পরিচয় নিয়েও ছিল কিঞ্চিৎ ধোঁয়াশা। তার উপরে সাড়ে তিন বছর আগেকার ঘটনা। তখন মামলা, তদন্ত কিছুই হয়নি। খুনের মামলা রুজু হয় চলতি বছরের এপ্রিলে। তা সত্ত্বেও এলাকায় সোর্স নেটওয়ার্ক কাজে লাগিয়ে ঠাকুরপুকুর থানার পুলিশ এত দিন পরে হদিস পায় খুনের একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী এক মহিলার। যিনি ওই খুন দেখে ফেলায় আততায়ীদের হুমকির মুখে পড়ে ঠাকুরপুকুরের শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে ফলতায় বাপেরবাড়ি চলে যান। আর কোনও দিন শ্বশুরবাড়ি মুখো হননি। সেই মহিলার বয়ান থেকেই ঠাকুরপুকুরে এক যুবকের হত্যা রহস্যের সম্প্রতি কিনারা করে ফেলেছে পুলিশ।
চপারের এক এক কোপে ওই যুবকের মাথা, হাত, পা কেটে নেওয়ার ঘটনায় তিন জন ধরা পড়েছে। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হয়েছে হাতিয়ারও। কিন্তু আততায়ীরা ছিল মোট চার জন। পুলিশ জানায়, চতুর্থ জনকে এখনও চিহ্নিত করা যায়নি। শ্যামবর্ণ ওই ব্যক্তির খোঁজে নতুন উদ্যমে চলছে তল্লাশি।
আলিপুর আদালত সূত্রের খবর, ঠাকুরপুকুরের রাজনাথপুর কলোনির বাসিন্দা, পেশায় রিকশাচালক নজরুল ইসলাম ওরফে বাচ্চু (৩৮) নিখোঁজ হন ২০১৩-র ১০ সেপ্টেম্বর। পরদিন স্থানীয় হাঁসপুকুর খালে উদ্ধার হয় এক পুরুষের ‘টরসো’। হাত-পা-মুণ্ডহীন দেহ। পুলিশ জানায়, মাথাটি মেলেনি। তবে উদ্ধার হয় দু’টি হাত। যার মধ্যে ডান হাতে কাটা চিহ্ন ছিল। নজরুলের মা রেহানা খাতুন ওই চিহ্ন দেখে দাবি করেন, ওটি তাঁর ছেলের দেহ। তা ছাড়া, টরসোর অদূরে উদ্ধার হওয়া রিকশাও তাঁর ছেলের বলেই জানান তিনি। কিন্তু টরসোর যে সব নমুনা ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞদের কাছে পাঠানো হয়, তার কোষগুলি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ডিএনএ মিলিয়ে দেখা যায়নি।
নজরুলের মা কিন্তু হাল ছাড়েননি। রেহানার আবেদনের জেরেই এই বছর ২৬ এপ্রিল ঠাকুরপুকুর থানার পুলিশ স্বতঃপ্রণোদিত বা সুয়ো মোটো খুনের মামলা রুজু করে। টরসো যাঁর, তাঁকে প্রথমে অজ্ঞাতপরিচয় বলে উল্লেখ করা হয়।
আদালত সূত্রের খবর, ফলতায় বাপেরবাড়ি চলে যাওয়া মহিলা পুলিশকে জানান, ২০১৩-র ১০ সেপ্টেম্বর রাতে কাজ সেরে শ্বশুরবাড়ি ফেরার সময়ে চেকপোস্ট সর্দারপাড়ায় একটি ঘরের ভিতর থেকে ধুপধাপ আওয়াজ পান। দরমার ফাঁক দিয়ে তিনি দেখেন, চার জন মিলে নজরুল ওরফে বাচ্চুকে প্রথমে পিছমোড়া করে বাঁধে, তার পর এক এক কোপে নামিয়ে দেওয়া হয় তাঁর মুণ্ড, হাত ও দুই পা। ওই মহিলা ভয়ে চিৎকার করে ওঠেন। আততায়ীরা তাঁকে হুমকি দেয়, মুখ বন্ধ না রাখলে তাঁর হাল বাচ্চুর মতো হবে। বাঁচবেন না তাঁর স্বামীও।
আলিপুর আদালতের বিচারকের কাছে গোপন জবানবন্দি দেন ওই মহিলা। তার পরে পুলিশ এক এক করে গ্রেফতার করে বাবলু বৈদ্য, বাবলু মণ্ডল ও মহম্মদ জাভেদ ওরফে দাঁতবাবুকে। দাঁতবাবুও পেশায় রিকশাচালক। বাবলু বৈদ্য জমির দালাল, বাবলু মণ্ডল ফল বিক্রেতা। তদন্তে জানা যায়, ওই তিন জন মাদক সেবন করত। কিন্তু ওই তল্লাটে পুলিশের চর হিসেবে কাজ করা নজরুল কিছু মাদকের ডেরার হদিস দিয়েছিলেন থানায়। সেগুলি পুলিশ বন্ধ করে দেয়। সেই আক্রোশ থেকেই নজরুলকে খুন করা হয়। তার আগে জোর করে ওই যুবকের মুখে চার জন মিলে হেরোইন গুঁজে দিয়ে তাঁকে অসাড় করে দিয়েছিল বলেও অভিযোগ।
যেখানে নজরুলকে খুন করা হয়, সেই ঘর ছিল দাঁতবাবুর ভাড়া নেওয়া। ওই ঘর থেকে খুনে ব্যবহৃত চপারটি উদ্ধার করেছে পুলিশ।
খুনের পরে রাত দেড়টা নাগাদ একটি বড় সাদা বস্তায় নজরুলের টরসোটি ভরে তাঁরই রিকশায় চাপিয়ে নিজে চালিয়ে সেটি হাঁসপুকুর খালে ফেলে দেয় দাঁতবাবু। ঠাকুরপুকুর বাজারের কাছে দাঁতবাবুকে সেই সময়ে দেখেছিলেন স্থানীয় এক ব্যবসায়ী। তাঁকেও পুলিশ সাক্ষী হিসেবে পেয়েছে। ওই ব্যবসায়ী জরুরি কাজে যাচ্ছিলেন। তিনি দাঁতবাবুকে রিকশা করে কিছুটা এগিয়ে দিতে বলেন। কিন্তু দাঁতবাবু জানায়, তাকে বস্তা ভর্তি জিনিস তাড়াতাড়ি পৌঁছে দিতে হবে। পরদিন হাঁসপুকুর খালে ওই সাদা বস্তার মধ্যেই টরসোটি পাওয়া গিয়েছিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy