Advertisement
১৯ মে ২০২৪
হাসপাতালে গুন্ডাগিরি

রোগীর ‘পরিজন’ হয়ে হামলা করে অন্যরা

বিভিন্ন হাসপাতালে ডাক্তারদের উপরে হামলার ঘটনা এখন নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। রোগীর মৃত্যু কিংবা চিকিৎসায় গাফিলতির কোনও অভিযোগ উঠলেই ডাক্তারদের মারধর করাটা কার্যত নিজেদের অধিকার বানিয়ে ফেলেছেন কিছু মানুষ।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০১:৪৩
Share: Save:

বিভিন্ন হাসপাতালে ডাক্তারদের উপরে হামলার ঘটনা এখন নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। রোগীর মৃত্যু কিংবা চিকিৎসায় গাফিলতির কোনও অভিযোগ উঠলেই ডাক্তারদের মারধর করাটা কার্যত নিজেদের অধিকার বানিয়ে ফেলেছেন কিছু মানুষ। যদিও কখনও কখনও এর উল্টো অভিযোগও ওঠে। আর তাই খোদ মুখ্যমন্ত্রীকেও এসএসকেএম হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তারদের সংযত আচরণ করার নির্দেশ দিয়ে আসতে হয়।

সাধারণ ভাবে দেখা যায়, ডাক্তারদের উপরে হামলার ঘটনায় শুধু রোগীর বাড়ির লোক নয়, তাঁদের সঙ্গে প্রায় সব সময়েই যোগ দেন এমন কিছু লোকজন আদতে ওই ঘটনার সঙ্গে যাঁদের কোনও যোগই নেই। এঁরা কেউ হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণির স্থায়ী বা অস্থায়ী কর্মী। কেউ দোকানদার, কেউ এলাকার রিকশা বা অটোচালক। ডাক্তারদের উপরে চড়াও হওয়া বা হাসপাতালে হল্লা করার ক্ষেত্রে স্থানীয় ভাবেএই মুখগুলোই বার বার ফিরে আসে।

কেন করেন তাঁরা এই গুণ্ডাগিরি? বিভিন্ন অভিযোগের অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা গিয়েছে, বেশির ভাগ
ক্ষেত্রেই এঁদের পিছনে রাজনৈতিক মদত রয়েছে। চিৎকার-চেঁচামেচি বা মারধর করে নিজেদের প্রভাবটা অন্যদের বোঝাতে চান তাঁরা। যে ‘প্রভাব’ পরবর্তী সময়ে নানা ক্ষেত্রে তাঁদের কাছে লাভজনক হয়ে ওঠে।

ঠিক যেমন বুধবার রাতে ন্যাশনাল মেডিক্যালের ক্ষেত্রে ঘটেছে। এক প্রসূতির সঙ্গে এক আয়ার গোলমাল বেধেছিল। কিন্তু সেখানে রাতারাতি অন্য আয়াদের দল এসে হাজির হয়। তারাই চেঁচামেচি-ধাক্কাধাক্কি করে পরিস্থিতিকে আরও ঘোরালো করে তোলেন। পরে অবশ্য সুপার পীতবরণ চক্রবর্তী দাবি করেন, ওই প্রসূতির কিছু মানসিক সমস্যা ছিল। তিনি নিজের পোশাক ছিঁড়ে ফেলছিলেন। তাই তাঁকে শান্ত করার চেষ্টা চলছিল। যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি মোটেই আয়া নন, হাসপাতালের স্থায়ী চতুর্থ শ্রেণির কর্মী।

ন্যাশনাল মে়ডিক্যালের চিকিৎসক ও কর্মীদের বড় অংশ কিন্তু জানাচ্ছেন, অবৈধ ভাবে বহাল আয়া এবং অস্থায়ী কর্মীদের দাপটেই হাসপাতালে স্বাভাবিক কাজকর্ম বার বার ধাক্কা খায়। অতীতে এর ভুরি ভুরি নজির রয়েছে। ন্যাশনাল থেকে এক সময়ে প্রায়ই সদ্যোজাত উধাও হওয়ার অভিযোগ উঠত। সেখানেও আয়াদের একটা দল জড়িত বলে ডাক্তারদের অভিযোগ। কিন্তু খোদ হাসপাতাল কর্তারাই এমন তটস্থ থাকেন যে বেআইনি ভাবে কাজ করা আয়াদেরও তাঁরা সরাতে পারেননি।

এমনিতেই শহরের বিশেষ কিছু এলাকার হাসপাতালে সামান্য ইন্ধনেই বড়সড় গোলমাল বাধে। যেমন ন্যাশনাল মেডিক্যাল ও একবালপুরের এক বেসরকারি হাসপাতাল। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তো বটেই, এমনকী স্বাস্থ্যকর্তারাও মানেন, এ রাজ্যে জুনিয়র ডাক্তাররা সবচেয়ে বেশি মার খেয়েছেন ন্যাশনালেই। সেখানে প্রায় প্রত্যেকটি গোলমালেই অস্থায়ী কর্মী ও আয়াদের পাশাপাশি অন্য দু’তিনটি মুখ থাকেই। এঁদের মধ্যে এক জন এলাকার এক ফলবিক্রেতা। অন্য জন এক রিকশাচালক। অভিযোগ, যে কোনও গোলমালে রোগীর বাড়ির লোকজনের সঙ্গে সুর মিলিয়ে এঁরা চড়াও হন ডাক্তার-নার্সদের উপরে।

আরজিকরে এই গুন্ডারাজ এমনই প্রবল যে এক বার এক লিফটম্যান ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত হওয়ার পরে তার গ্রেফতারির প্রতিবাদে হাসপাতাল চত্বরের কিছু দোকানি এবং বস্তিবাসী বেকার যুবক কর্তৃপক্ষকে শুধু মারতে বাকি রেখেছিলেন। তাঁরা শাসকদলের মদতপুষ্ট বলে অভিযোগ। এখানেই শেষ নয়, শাসক দলের এক সভায় হাসপাতালের যে কর্মীরা যাননি, পরবর্তী বেশ কয়েকদিন তাঁদের হাজিরা খাতায় সইও করতে বাধা দিয়ে প্রবল গোলমাল বাধান ওই ‘দাদা’ তথা দালালরা।

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এঁরা কোনও না কোনও রাজনৈতিক নেতার ছত্রচ্ছায়ায় থাকেন বলে পার পেয়ে যান। কলকাতা মেডিক্যাল ও এনআরএসে এই দালালরাই মাঝেমধ্যে কিছু লোকের অস্থায়ী চাকরির দাবি তোলে। কর্তৃপক্ষ দাবি না মানলেই শুরু হয় রাজনৈতিক নেতাদের নাম করে গালি এবং বদলির হুমকি। কোথাও চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ উঠলে এই ‘দাদা’রাই সক্রিয় হয়ে ওঠেন। ডাক্তারদের মারধর করার ব্যাপারে নেতৃত্বও দেন তাঁরা।

এসএসকেএমের এক জুনিয়র ডাক্তার শোনাচ্ছিলেন তাঁর অভিজ্ঞতার কথা। মাঝরাতে সার্জারি বিভাগের জুনিয়র ডাক্তাররা হাঁফাতে হাঁফাতে ওয়ার্ডের বাইরে বেরিয়ে এসেছিলেন। তাঁদের তাড়া করেছিলেন মৃতের আত্মীয়রা। মিনিট কয়েক আগেই পথ দুর্ঘটনায় আহত এক যুবকের মৃত্যু হয়েছিল। তার পরেই চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ তুলে বাড়ির লোকেরা ডাক্তারদের উপরে চড়াও হন। বাইরে বেরিয়ে ডাক্তাররা যখন আত্মরক্ষার চেষ্টা চালাচ্ছেন, তখন তাঁদের ঘিরে ফেলেছিলেন হাসপাতালেরই কর্মী আবাসনের কয়েক জন বাসিন্দা। এঁরা কেউই আদতে হাসপাতালের কর্মী নন। কোনও কর্মীর সূত্র ধরে বেআইনি ভাবে ঘর দখল করে রেখেছেন। বাঁশ, লোহার রড তাঁরাই জোগান দিয়েছিলেন মৃতের আত্মীয়দের। সেই রাতের কথা মনে পড়লে এখনও শিউরে ওঠেন ওই ডাক্তাররা। হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ি থেকে লোকজন এসে কোনওমতে তাঁদের বাঁচিয়েছিল। এই এসএসকেএমেই কর্তৃপক্ষ চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের অবৈধ নির্মাণ ভাঙতে গেলে রণক্ষেত্রের চেহারা নিয়েছিল হাসপাতাল চত্বর।

তা হলে কি এ ভাবেই চলতে থাকবে? স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘সমস্ত রাজনৈতিক দলের অফিসগুলো হাসপাতাল চত্বর থেকে ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। অভিযোগ ছিল, এই সব অফিস থেকেই দালালরাজ এবং গুণ্ডাগিরি পরিচালিত হত। অন্তত সেটুকু তো বন্ধ হোক। তার পর পরের বিষয় ভাবা হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Hospital Patient Conflict
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE