Advertisement
০৫ মে ২০২৪

গতে-বাঁধা পরিচয়ে আপত্তি দময়ন্তী সেনের

পুলিশমহলে একটি মিথ, তিনি না কী ‘ম্যাডাম’ ডাকটা শুনতে পছন্দ করেন না। এবং এটা নিছকই ‘মিথ’! তবে শুধু ‘ম্যাডাম’ নয় ‘স্যার’ বলেও তাঁকে ডাকেন বহু অধস্তন পুলিশকর্মীই।

ঋজু বসু
শেষ আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০১৫ ১৯:২৩
Share: Save:

পুলিশমহলে একটি মিথ, তিনি না কী ‘ম্যাডাম’ ডাকটা শুনতে পছন্দ করেন না। এবং এটা নিছকই ‘মিথ’! তবে শুধু ‘ম্যাডাম’ নয় ‘স্যার’ বলেও তাঁকে ডাকেন বহু অধস্তন পুলিশকর্মীই।

দেখা গিয়েছে, তিনি নিজে সমান স্বচ্ছন্দ এই দু’রকম সম্বোধনে। ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ কী বলে তাঁকে ডাকা হল সেটা অবান্তর! রাজ্য পুলিশের আইজি (অর্গানাইজেশন) দময়ন্তী সেন শুধু সচেতন তাঁর ‘চেয়ার’টির মর্যাদা নিয়ে। বরাবরই এমন ছিলেন তিনি। কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দাপ্রধান, ডিআইজি (দার্জিলিং রেঞ্জ), ডিআইজি (সিআইডি), বা ডিসি (নর্থ)-এর মতো বহু গুরুত্বপূর্ণ পদ দময়ন্তী সামলেছেন। লালবাজারে, ভবানী ভবনে বা অন্যত্র তাঁকে দূর কিংবা কাছ থেকে যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা সকলেই মানেন জেন্ডার বা লিঙ্গগত পরিচয়ের নিগড়ে এই পুলিশকর্তাটি কখনওই বাঁধা পড়তে চাননি।

এমনিতে কিছুটা ‘অপ্রিয় সত্যভাষী’ বলেই তাঁর খ্যাতি পুলিশ বা সাংবাদিক-মহলে। কটকট করে উচিত কথা বা যেটা তিনি ঠিক মনে করছেন শুনিয়ে দিতে পিছপা হন না দময়ন্তী। তা বলে এটা তথাকথিত পুরুষসুলভ কঠোর আগ্রাসী ভাবমূর্তি তৈরির চেষ্টা ভাবাটা ডাহা ভুল হবে। বরং, প্রচারের আলো মুখে এসে পড়া নিয়ে যে-সব পুলিশকর্তার আন্তরিক অ্যালার্জি তিনি সেই লিস্টে ওপরের দিকে থাকবেন। কিন্তু প্রচারের আলোই মাঝেমধ্যে তাঁকে তাড়া করে বেড়ায়।

প্রত্যাশামতোই বহুচর্চিত পার্ক স্ট্রিট গণধর্ষণ-কাণ্ডে বিচারের রায় দানের দিনও কোথাও মুখ খোলেননি তিনি। চেনা সাংবাদিকদের ফোন পারতপক্ষে ধরেননি। কেউ দেখা করতে গেলে, ‘মিটিংয়ে আছি’ বলে এড়িয়ে গিয়েছেন। তবু এই দিনটিতে ঘুরে-ফিরে তিনিই পুলিশ বা সাংবাদিকমহলে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছেন।

পার্ক স্ট্রিট-কাণ্ডের অভিযোগকারিনী সুজেট জর্ডন প্রয়াত হওয়ার পরে প্রশ্নাতীত ভাবে এই মামলার প্রধান চরিত্র এখন দময়ন্তী নিজেই। লালবাজার ছেড়ে তিনি চলে যাওয়ার তিন বছর কেটে গেলেও পার্ক স্ট্রিট ধর্যণের মামলা, তদন্তকারী দময়ন্তী সেনের মুকুটের একটি পালক হিসেবেই জনগণের স্মৃতিতে থেকে গিয়েছে।

গোড়ায় অভিযোগ নিয়ে সংশয় তৈরি হলেও গোয়েন্দাপ্রধান দময়ন্তী তাতে প্রভাবিত হননি। ‘অপরাধমূলক কিছু একটা যে ঘটেছে’ এই বিশ্বাসে অনড় হয়ে লেগে থাকেন তিনি। দময়ন্তী ও তাঁর টিমের হাতে অভিযুক্তরা ধরার পড়ার পরে অভিযোগকারিণী টিভি সাক্ষাৎকারে তাঁকে ‘বাঘিনী’ আখ্যা দিয়েছিলেন। প্রতিবাদী নায়ক বা বীরাঙ্গনার তকমা সেঁটে যায় দময়ন্তীর গায়ে! তখন ফেসবুকে ‘ফ্যান্স অফ দময়ন্তী সেন’-কমিউনিটি গড়ে উঠছে, তাঁর প্রশস্তিতে গান বাঁধা হচ্ছে, তুমুল লেখালেখি চলছে সংবাদমাধ্যমে। দময়ন্তীকে যাঁরা চেনেন, তাঁরা অনেকেই জানেন, তীব্র ভাবে টিমম্যান দময়ন্তী নিজে এই বীরপুজোয় কতটা বিব্রত হয়েছিলেন।

এর কয়েক দিনের মধ্যেই ব্যারাকপুরে তথাকথিত কম গুরুত্বের পদে (রাজ্য পুলিশের ডিআইজি, ট্রেনিং) পাঠানো হয় তাঁকে, যা অনেকেই পার্ক স্ট্রিট-কাণ্ডে তাঁর ‘অত্যুৎসাহে’র মাসুল বলে ধরে নিয়েছিলেন। কিন্তু অশান্ত দার্জিলিংয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ফের ডাক পড়ে দময়ন্তীর। অনেকে তখন বলাবলি শুরু করছিলেন, এ যেন বাঘ মারতে শত্রুকে পাঠানোর সামিল! কেউ কেউ অবশ্য বলেন, এই বদলি তাঁর প্রতি প্রশাসনের আস্থারই প্রকাশ। যা-ই হোক, পরিবার ছেড়ে পেশাগত জীবনের নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে দময়ন্তী অবশ্য দ্বিধা করেননি। এবং সেখানে তাঁর কাজের জোরেই রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষস্তরে নজর কাড়েন তিনি। তাঁকে কলকাতায় সিআইডি-র গুরুত্বপূর্ণ পদে ফিরিয়ে আনা হয়।

অর্থাৎ তাঁকে ঘিরে সাময়িক বিতর্ক দানা বাঁধলেও কাজই বার বার দময়ন্তী সেনের পরিচয় হয়ে উঠেছে। মধ্যমগ্রাম-কাণ্ডের মতো স্পর্শকাতর তদন্ত হাইকোর্টকে জানিয়ে ডিআইজি (সিআইডি) দময়ন্তীর উপরেই ন্যস্ত করেছিল রাজ্য সরকার। হাইকোর্ট পাড়ুইয়ের সাগর ঘোষ খুনের তদন্তভারও একটা পর্যায়ে তাঁকেই সামলাতে হয়।

তবে পুলিশ হিসেবে নাম-ডাক ছড়ালেও বাস্তবিক নিজের মাপের বাইরে গিয়ে বাঘিনী হওয়ার চেষ্টা কখনওই করেননি ’৯৬ সালের ব্যাচের এই আইপিএস অফিসার। বরং বলা যায়, নিজের ব্যক্তিসত্তাটিকে বাঘিনীর মতোই আগলে রেখেছেন বহির্জগতের কৌতূহলের সামনে। ব্যক্তিগত জীবনের দময়ন্তী ও পুলিশ দময়ন্তী দু’টি আলাদা খোপ। ওয়াটারটাইট কম্পার্টমেন্ট-এর মতো একটির জল অন্যটিতে মিশবে না।

সোশ্যাল নেটওয়ার্কে দময়ন্তীকে খুঁজে পাওয়ার আশা করবেন না। তাঁর সহকর্মীরা অবধি কালে-ভদ্রে এই ব্যস্ত মহিলার স্বামী, পুত্র নিয়ে ঘরকন্নার আভাস পেয়েছেন। তাঁর স্বামী (বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক) ও স্কুলপড়ুয়া পুত্রকেও পারতপক্ষে কোনও সিনিয়র আইপিএস, আইএএস-এর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়ার পথে হাঁটেন না দময়ন্তী। তাঁর বিষয়ে এটুকু জানা যায়, তিনি সাউথপয়েন্ট স্কুল ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্রী। সফল পুলিশকর্তা হিসেবে তাঁর ব্যক্তি জীবন নিয়ে চূড়ান্ত অ-বিতর্কিত নিরামিষতম ইন্টারভিউয়ের জন্যও বার-বার কড়া ভাবে মিডিয়াকে দরজা থেকে ফিরিয়ে দিয়েছেন দময়ন্তী।

কেন? তাঁর ঘনিষ্ঠমহলের মত, আসলে কোনওরকম গতে-বাঁধা পরিচয় বা স্টিরিওটাইপেই তীব্র বিতৃষ্ণা দময়ন্তীর! তাঁর সিনিয়র-জুনিয়র সহকর্মীদের কাছে এত দিনে মহিলা বা পুরুষ নন, তাঁর পুলিশ পরিচয়টুকুই প্রতিষ্ঠিত। পুলিশ-আমলামহলে বেশিরভাগেরই সন্দেহ নেই, দময়ন্তীর পেশাগত দক্ষতা ও বুদ্ধির ধার নিয়ে। কিন্তু পুলিশের জগতে চোখে পড়ার মতো একজন সংখ্যালঘু হিসেবে তিনি বোধহয় কিছুটা শশব্যস্ত, মেয়েদের মধ্যে ফার্স্ট তকমাটি নিয়েও।

হ্যাঁ, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে এই পরিচয়টিকে ঘৃণাই করেন দময়ন্তী। তাই তিনি যে টিমের আর-পাঁচজনের থেকে আলাদা নন, এই বোধটাই সব সময়ে বাকিদের মাথায় স্পষ্ট ঢুকিয়ে দিয়েছেন। দময়ন্তী চান, তাঁর সামনে সবাই স্বাভাবিক থাকুন, তিনি নিজেও তেমনই থাকেন! সকলেই বলেন, পুলিশের চাকরির দায়বদ্ধতা মেনে রাতেও যে-কোনও সময়ে ফোন করা যায় ‘ম্যাডাম’কে। যে কোনও কঠিন কেসের জট পাকালে সবার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে রাতভর কাজ করেছেন। আবার সাত-সকালে অফিসে হাজির হতেও তাঁর ক্লান্তি নেই। কিন্তু সংসারের কাজ সামলে বা বাচ্চাকে স্কুলের জন্য তৈরি করে তাঁকে আসতে হয়েছে কি না, সে-প্রসঙ্গ কেউ চর্চার সুযোগ পাননি।

এর পরেও কি মহিলা হিসেবে তাঁর জন্য কখনও কোনও বিশেষ ‘ট্রিটমেন্ট’ বরাদ্দ হয়নি কাজের জগতে? এমন দেখা গিয়েছে, বয়সে অগ্রজ কোনও জুনিয়র অফিসার মার্জিত ভঙ্গিতে ‘ম্যাডাম’কে অমুক বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে না বলে পরামর্শ দিয়েছেন। তখন তেমনই মার্জিত ভাবে কিন্তু দৃঢ় স্বরে দময়ন্তীর প্রতিক্রিয়া: ‘না, না, আমি ভাবব কেন? ভাববেন তো আপনিই! আমার কাজ সুপারভাইজ করা (তদারকি)!’

পুলিশের চাকরিতে মেয়ে হওয়াটা যে দুর্বলতা নয়, সেটা বার বার প্রমাণ করেছেন দময়ন্তী। উত্তর কলকাতার বিডন স্ট্রিটের কাছে এক শিশুকে অপহরণের পরে মার-ধর করে একটি পরিত্যক্ত বাগানে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। বাচ্চা মেয়েটিকে উদ্ধারের পরে হাসপাতালে বেশ ক’দিন সে আতঙ্কের মধ্যে ছিল। দময়ন্তী দীর্ঘ সময়ে তার বেডের পাশে বসে থেকেছেন। বাচ্চাটির সঙ্গে ভাব করেছেন! তারপরে বাচ্চাটিকে যে ওই তল্লাটে কুকুরওলা একটি বাড়িতে আটকে রাখা হয়েছিল, সেই তথ্যটা তিনিই বার করেন। ওই ক্লু-র জোরেই শেষমেশ অপরাধী ধরা পড়ে।

গুরুত্বপূর্ণ কোনও অপরাধী ধরা পড়লে যে-সব পুলিশকর্তা নিজে জেরা করে সরাসরি বিষয়টির সঙ্গে যুক্ত হতে ভালবাসেন, দময়ন্তী তাঁদেরও একজন। তবে কোনও ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত কৃতিত্ব তিনি জাহির করেননি। কোনও কেসের সাফল্য-ব্যর্থতা টিমের সবার বলেই তিনি বরাবর দেখে এসেছেন।

পুনশ্চ: তবে পুলিশ দময়ন্তীকে মাঝেমধ্যে প্রকাশ্যে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে দেখা গিয়েছে। গোয়েন্দাপ্রধানের পদ থেকে বদলি হওয়ার পরে লালবাজারে তাঁর বিদায়ী-সম্বর্ধনায় দু’টি গান গেয়েছিলেন। ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে’ ও ‘সার্থক জনম আমার, জন্মেছি এই দেশে’!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

damayanti sen police lalbazar station
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE