Advertisement
২০ মে ২০২৪
বিধাননগর

অকর্মণ্য পুরসভা, উদ্বেগজনক হচ্ছে ডেঙ্গি-পরিস্থিতি

ডেঙ্গিতে মৃত্যু যত বাড়ছে, ডেঙ্গি নিয়ন্ত্রণে বিধাননগর পুরসভার অকর্মণ্যতা দিনদিন ততই প্রকট হচ্ছে। এতটাই যে, নিজের ওয়ার্ডে ডেঙ্গিতে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর খবর পেতে পাঁচ দিন সময় লাগল মেয়র পারিষদ (স্বাস্থ্য) প্রণয় রায়ের।

প্রবাল গঙ্গোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০১:৫৫
Share: Save:

ডেঙ্গিতে মৃত্যু যত বাড়ছে, ডেঙ্গি নিয়ন্ত্রণে বিধাননগর পুরসভার অকর্মণ্যতা দিনদিন ততই প্রকট হচ্ছে। এতটাই যে, নিজের ওয়ার্ডে ডেঙ্গিতে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর খবর পেতে পাঁচ দিন সময় লাগল মেয়র পারিষদ (স্বাস্থ্য) প্রণয় রায়ের।

জুন-জুলাই মাসে ডেঙ্গি সংক্রমণ শুরু হওয়ার পরে কিছুদিন কোথায় কোথায় ডেঙ্গি হয়েছে, ডেঙ্গি সংক্রমণের কী কারণ, মশা মারতে কী কী করা উচিত, তা নিয়ে নিয়মিত বৈঠকে বসছিল বিধাননগর পুরসভা। কিন্তু রোগটা যখন দ্রুত বেগে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল, কখনও সল্টলেক, কখনও নিউ টাউন, কখনও বাগুইআটি থেকে মৃত্যুর খবর আসতে লাগল, তখন ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল পুরসভার ডেঙ্গি প্রতিরোধ বাহিনী। তার জেরে ডেঙ্গির হিসেব রাখার পদ্ধতি মাথায় উঠল। মশা নিধনের কাজ কার্যত বন্ধ হয়ে গেল। শুরু হয়ে গেল দোষারোপের পালা। আর সেই সুযোগে মশককুল বাড়তে লাগল বাড়ির আনাচেকানাচে।

ডেঙ্গি-আক্রান্ত এলাকাগুলির উপরে পুর-কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ যত কমছে, ততই সংক্রমণের দ্রুত খবর আসা বন্ধ হয়ে গিয়েছে পুর ভবনে। সোমবারই বাগুইআটির রেলপুকুর রোডে মৃত্যু হয়েছে এক ব্যক্তির। সোমবার সেই ঘটনার তদন্তে নেমে মঙ্গলবার পুর-কর্তৃপক্ষ জানতে পারলেন, সোমবারই মিহির বিশ্বাস (৫২) নামে ওই এলাকার এক ব্যক্তি সল্টলেকের একটি বেসরকারি হাসপাতালে মারা গিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, গত ৮ তারিখ ডেঙ্গিতেই মৃত্যু হয়েছিল ওই এলাকার আরও এক ব্যক্তির। তিনটি মৃত্যুর ঘটনাই ঘটেছে পুরসভার ১০ নম্বর ওয়ার্ডে। ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পুরসভার মেয়র পারিষদ (স্বাস্থ্য) প্রণয় রায়।

নিজের ওয়ার্ডে ডেঙ্গিতে মৃত্যুর খবর পেতে পাঁচ দিন? প্রণয়বাবু বলেন, ‘‘এটা ঠিক যে সময় মতো আমার কাছে খবর আসেনি।’’ নিজের ওয়ার্ডের খবরই যদি ঠিক সময়ে মেয়র পারিষদ না পান, তা হলে গোটা পুরসভার ৪১টি ওয়ার্ডের খবর কী ভাবে পাবেন তিনি? কী ভাবেই বা পুরসভা ডেঙ্গি নিয়ন্ত্রণ করবে? প্রণয়বাবুর কাছে এই প্রশ্নের জবাব ছিল না। তবে পুরসভার একটি সূত্রের খবর, ডেঙ্গি দমনে বিধাননগর পুরসভার নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী সমালোচনা করার পরে পুরসভার উচ্চ স্তর থেকে ‘ধীরে চলো’ নীতি নেওয়া হয়েছে। মানুষের মনে যাতে অযথা আতঙ্ক না ছড়ায় তার জন্য এই ব্যবস্থা। মেয়র পারিষদ স্বাস্থ্য অবশ্য এই অভিযোগ মানতে চাননি। তিনি বলেন, ‘‘নিয়মিত বাড়ি বাড়ি মেডিক্যাল টিম যাচ্ছে।’’ তবে সল্টলেকের বাসিন্দাদের অধিকাংশেরই অভিযোগ, তাঁরা ওই মেডিক্যাল টিম চোখে দেখেননি।

পুরসভার হিসেব মতো এখনও পর্যন্ত বিধাননগর পুর এলাকায় ডেঙ্গিতে মৃতের সংখ্যা ন’জন। পুরসভার হিসেব বলছে, ২৬০০ জন জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন। এঁদের মধ্যে ডেঙ্গি-আক্রান্তের সংখ্যা ১০০। অর্থাৎ, বিধাননগর পুরসভার ৪১টি ওয়ার্ডে গড়ে দু’জনেরও বেশি লোক ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়েছেন। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, পুরসভার হিসেবের চেয়ে জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি। বাড়ি বাড়ি সমীক্ষা চালাক পুরসভা। তা হলেই আসল তথ্যটা জানা যাবে।

সোমবার সন্ধ্যায় বাগুইআটির রেলপুকুর রোডের বাসিন্দা মিহির বিশ্বাস (৫২) সল্টলেকের একটি বেসরকারি হাসপাতালে মারা যান। মিহিরবাবু একটি প্যাথলজিক্যাল ক্লিনিক চালাতেন। ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়ে গত ৬ সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার তিনি জ্বর নিয়ে ভিআইপি রোডের ধারে একটি নার্সিংহোমে ভর্তি হন। পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় রবিবার তাঁকে সল্টলেকের ওই বেসরকারি হাসপাতালে স্থানান্তরিত করতে হয়। মৃতের দাদা, মৃণালকান্তি বিশ্বাস নিজে চিকিৎসক। তিনি এ দিন বলেন, ‘‘আমি ডেঙ্গি নিয়ে অতীতে রাজারহাট-গোপালপুর পুরসভার সঙ্গে কাজ করেছি। ডেঙ্গি এই এলাকায় মহামারীর আকার নিয়েছে। প্রশাসনের আরও তৎপর হওয়া উচিত।’’

মৃণালবাবুরই তত্ত্বাবধানেই তাঁর এক প্রতিবেশী উমাশঙ্কর বসু বল (৪৫) নামে এক ব্যক্তির ডেঙ্গির প্রাথমিক চিকিৎসা হয়। তার পরে তিনি ভিআইপি রোডের ধারে একটি নার্সিংহোমে গত ৮ সেপ্টেম্বর মারা যান। সেই খবরও মঙ্গলবার পেয়েছে পুরসভা। মঙ্গলবার উমাশঙ্করবাবুর দাদা পার্থসারথি বসু বল বলেন, ‘‘দীর্ঘদিন ধরে বাড়ির সামনে থাকা আবর্জনায় ভরা একটা ফাঁকা জমি নিয়ে কাউন্সিলরকে বলেছিলাম। সেখানে বৃষ্টি হলেই জল দাঁড়িয়ে যায়। কিন্তু অন্যের জমিতে পুরসভা ঢুকবে না বলে তিনি জানান। আমরা নিজেরাই আজ জঙ্গল সাফ করিয়েছি।’’

যদিও মেয়র পারিষদের পাল্টা দাবি, অন্যের জমিতে পুরসভা আবর্জনা তুলবে না এমন কথা বলা হয়নি। তিনি বলেন, ‘‘গতকাল চিঠি দেওয়া হয়েছিল। এ দিন আমরা গাড়ি পাঠিয়েই আবর্জনা তুলেছি।’’

কেন ডেঙ্গি দমনে এমন পিছিয়ে বিধাননগর? পুরকর্তাদের একাংশের কথায়, সাবেক বিধাননগর ও রাজারহাট-গোপালপুর পুরসভার পরিকাঠামো এক করে কর্পোরেশন হয়েছে। তাতে যে পরিকাঠামো রয়েছে, তা যথেষ্ট নয়। সীমাবদ্ধ ক্ষমতার মধ্যেই চেষ্টা চলছে। তার সঙ্গে কলকাতার মতো প্রাচীন পুরসভার তুলনা করা ঠিক নয়। তবে এটা ঠিক এ বারের অভিজ্ঞতায় ঠিক কী কী পরিকাঠামো প্রয়োজন তার রূপরেখাও মিলেছে।

বাসিন্দাদের প্রশ্ন, মাত্র এক বছরের পুরসভা। তার পরিকাঠামো যে দুর্বল, তা কি রাজ্য সরকার জানে না? রাজ্য প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও তাই ক্ষুব্ধ বাসিন্দারা। মেয়র পারিষদ (স্বাস্থ্য) প্রণয় রায় বলেন, ‘‘সীমিত ক্ষমতার মধ্যেই পুরসভা চেষ্টা চলছে। নিশ্চিত ভাবেই পরিকাঠামো বাড়ানো হবে। তবে যাতে আতঙ্ক না ছড়ায় সে দিকটিও সকলের ভাবা প্রয়োজন।’’

পুরসভার মেয়র সব্যসাচী দত্ত এখন কলকাতার বাইরে। মঙ্গলবার সারাদিন চেষ্টা করেও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Dengue kolkata alarming situation
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE