প্রবাদের গৌরী সেন কে ছিলেন, তা জানতে অনেক গবেষণা হয়েছে। অনেকে বলেন গৌরী আসলে ছিলেন এক নারী। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠদের দাবি, গৌরী আসলে গৌরীকান্ত সেন। বাংলা প্রবাদ বিষয়ক বিভিন্ন গবেষণাগ্রন্থ থেকে যা জানা যায়, তাতে গৌরী ছিলেন সুবর্ণবণিক সম্প্রদায়ের সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী। বাবা ছিলেন নন্দরাম সেন। ১৫৮০ সালের আশপাশে গৌরীর জন্ম হয় হুগলিতে। পরে কলকাতার কলুটোলা স্ট্রিটে থাকত সেন পরিবার। বিভিন্ন গবেষণায় এমনটাও দাবি করা হয়েছে যে, গৌরী আসলে ছিলেন হাওড়ার বালির বাসিন্দা। কেউ আবার বলেন হুগলি বা হাওড়া নয়, গৌরীর আদি বাড়ি ছিল মুর্শিদাবাদের বহরমপুর এলাকায়। জন্মস্থান নিয়ে নানা মত থাকলেও গবেষকরা সকলেই এটা বলেছেন যে, কলকাতার আহিরীটোলায় বাড়ি করেছিলেন ধনী গৌরীর বংশধররা। তাঁর ধনী হয়ে ওঠা নিয়েও রয়েছে অনেক কাহিনি। তার মধ্যে যেটা বেশি শোনা যায়, সেটি হল ব্যবসার অংশীদার বৈষ্ণবচরণ শেঠের সঙ্গে একটি ডুবে যাওয়া জাহাজে বোঝাই-করা দস্তা কিনেছিলেন গৌরী। কিন্তু পরে দেখতে পান আসলে দস্তার তলায় লুকিয়ে রুপো পাচার করা হচ্ছিল ওই জাহাজে। দস্তার দরে রুপো পেয়ে রাতারাতি ধনী হয়ে যান। ‘ঈশ্বরের কৃপায়’ পাওয়া অর্থের সবটা ভোগ না করে দানধ্যান শুরু করেন। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতামাতার জন্য নাকি তাঁর দরজা সব সময় খোলা থাকত, হাতও থাকত উপুড়-করা। আবার জমিদারের ঋণ শোধ করতে না পেরে জেলে যাওয়া প্রজাদের রক্ষা করতেও এগিয়ে আসতেন গৌরী। একটা সময়ে লোকমুখে তাঁর দান-গৌরব ছড়িয়ে পড়ে গোটা বাংলায়। প্রবাদ তৈরি হয়ে যায়— ‘লাগে টাকা, দেবে গৌরী সেন।’
বাপ-ঠাকুর্দার মুখে এ সব কাহিনি অনেক শুনেছেন দিব্যেন্দু। সেই সঙ্গে শুনেছেন তাঁদের পরিবারের অচল টাকার ব্যবসার ইতিহাসও। স্বাধীনতার পরে পরেই দাদু জিতেন্দ্রকুমার সেন শুরু করেন এই ব্যবসা। তখন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের লাইসেন্স লাগত। সাধারণ মানুষের থেকে সংগ্রহ করা নষ্ট-হওয়া নোট রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে বদলে আনার ব্যবসা। দিব্যেন্দুর বাবা অসীমকুমার সেনও একই ব্যবসা করেন। পরে দিব্যেন্দুর দাদা সন্দীপও। কাকাদের পরিবারেও ছিল এই ব্যবসা। কিন্তু একে একে সবাই ছেড়ে দিয়েছেন। আনন্দবাজার অনলাইনকে দিব্যেন্দু বললেন, ‘‘সবাই অন্য ব্যবসা করেন এখন। কিন্তু সব ব্যবসার মূলধন থেকে বাড়ি, গাড়ি যা হয়েছে সবই এই নোটবদলের কারবার থেকে।’’
কী ভাবে চলে এই ব্যবসা? দিব্যেন্দু জানালেন, বড়বাজারের সোনাপট্টিতে এমন ব্যবসায়ী আরও কয়েকজন রয়েছেন। বাংলার গ্রামেগঞ্জে অনেক মুদিখানা দোকান রয়েছে, যেখানে ছেঁড়া-ফাটা নোট সংগ্রহ করা হয়। কোন নোট কতটা ছেঁড়া, ফাটা বা পোড়া, তার উপরে নির্ভর করে কত টাকার বিনিময়ে তাঁরা সেটা কিনবেন। সেই সব নোটই আসে দিব্যেন্দুর মতো ব্যবসায়ীদের হাতে। এর পরে বাড়িতে এনে ছেঁড়া নোট জুড়ে বা নানা ভাবে সারাই করে তা ব্যাঙ্কে নিয়ে যেতে হয়। ব্যাঙ্কও যে পুরো অর্থ দেবে, তার কোনও মানে নেই। বদলের কিছু নিয়মও রয়েছে। সেই মতো দামেই কিনতে হয় দিব্যেন্দুদের। কারণ, ব্যাঙ্ক কত টাকা দেবে সেটা আগাম বুঝতে না পারলেই ঠকতে হবে। এখন অবশ্য রিজার্ভ ব্যাঙ্কে যেতে হয় না। আগের মতো ব্যবসা করতে শীর্ষ ব্যাঙ্কের লাইসেন্সও লাগে না। বিভিন্ন ব্যাঙ্কের কিছু শাখা এই কাজ করে। তেমন শাখা জেলায় জেলায় রয়েছে। তাই আগের মতো পুরনো নোট আর আসে না কলকাতায়। ফলে ব্যবসা ছোট হচ্ছে। তার কারণ হিসেবে নিজের দিকেও আঙুল তুললেন গৌরী সেনের বংশধর। বললেন, ‘‘আমিও তো আজকাল নগদ টাকায় কেনাকাটা কমিয়ে দিয়েছি। সবাই অনলাইনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। তাই নোট নষ্ট হওয়াও কমেছে। সবেরই খারাপ দিক, ভাল দিক আছে। এই যেমন অনলাইনে লেনদেন আমাদের ব্যবসার পক্ষে মোটেও ভাল নয়।’’
বলতে বলতেই পুরনো নোট জুড়তে মন দিলেন দ্যিবেন্দু। সঙ্গে জুড়লেন, কয়েক বছর আগেই পর্যটনের ‘সাইড’ ব্যবসা শুরু করেছেন। এ বার সেটাকেই ‘মেন’ করার কথা ভাবছেন তিনি। ভাবছেন। কারণ, পর্যটনকে মূল ব্যবসা করতে গেলেও তো টাকা লাগবে। গৌরী সেন কোথায়!