মগনলাল মেঘরাজকে ধরতে বারাণসীর ঘাটে সাধু সেজেছিলেন ফেলু মিত্তির।
ঠিক সিনেমার মতো না হলেও দক্ষিণ শহরতলির এক মাদক পাচারকারীকে ধরতে মাদকাসক্তের দলে ভিড়ে গিয়েছিলেন বেহালা থানা ও লালবাজারের অফিসারেরা। ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’ সিনেমায় মগনলাল মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করতেই স্বমূর্তিতে ফিরে এসেছিলেন ফেলুদা। শুক্রবার দুপুরের ‘অপারেশন’-এ মাদক বার করে বিক্রি করতেই নিজের রূপ ধরেছিল পুলিশ।
কাকতালীয়, সিনেমায় যেমন ফেলুদাকে সাহায্য করতে দূরে ওত পেতেছিলেন লালমোহনবাবু ও তোপসে, তেমনই দক্ষিণ শহরতলির মাদক পাচারকারী দীপ্তি দাসকে ধরতেও দূরে ঘাপটি মেরে ছিলেন একদল মহিলা পুলিশকর্মী। পুরুষ পুলিশকর্মীরা দীপ্তিকে ঘিরে ফেলতেই মহিলা পুলিশরা এসে পাকড়াও করেন তাকে। গ্রেফতার করা হয়েছে দীপ্তির ছেলে বাপন দাসকেও।
পুলিশ জানায়, দীপ্তির কাছ থেকে আড়াই কিলোগ্রাম চরস এবং দু’লক্ষ আশি হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। শনিবার আলিপুর আদালতে হাজির করানো হলে দু’জনকেই ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত পুলিশি হেফাজতের নির্দেশ দেন বিচারক।
কে এই দীপ্তি? পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, বেহালা, টালিগঞ্জ, ঠাকুরপুকুর এলাকায় চরস ও গাঁজা ব্যবসার বড় চক্র চালায় সে। আন্তর্জাতিক মাদক চক্রে কলম্বিয়ার মহিলা মাফিয়া গ্রিসেলডা ব্ল্যাঙ্কোর নাম গোয়েন্দা মহলে পরিচিত। সত্তর দশকের মাঝামাঝি মিয়ামি-সহ আমেরিকার একাধিক শহরের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করত গ্রিসেলডা ও তার দ্বিতীয় পক্ষের স্বামী। পুলিশ বলছে, দীপ্তির সঙ্গে অবশ্য গ্রিসেলডার তুলনা সে ভাবে টানা যায় না। ‘‘কিন্তু দক্ষিণ শহরতলির ছোট এলাকাতেই মাদক ব্যবসায় দীপ্তির দাপট দেখে কেউ কেউ এই তুলনা টানতে পারেন’’— বলছেন এক গোয়েন্দা অফিসার।
পুলিশ সূত্রে খবর, মাদক ব্যবসায় দীপ্তি ও তার ছেলে বাপনই ছিল মূল কারবারি। তাদের এজেন্ট হিসেবে কাজ করত ওই এলাকাগুলির বিভিন্ন মাদকাসক্ত যুবক। তাদের বিনামূল্যে মাদক দিত দীপ্তি। শুধু তাই নয়, এলাকায় টাকা ছড়িয়ে বেশ কিছু মহিলাকেও হাত করেছিল সে। এলাকার কয়েক জন ভ্যান ও রিকশাচালকও দীপ্তির এজেন্ট হিসেবে কাজ করত বলে গোয়েন্দাদের সন্দেহ।
কী ভাবে এই সন্দেহ করছে পুলিশ?
লালবাজারের একটি সূত্রের খবর, এর আগে কয়েক বার বেহালা গোবরঝুড়িতে দীপ্তির ডেরায় হানা দিতে গিয়ে পুলিশ দেখেছে, হানার খবর আগে থেকেই ফাঁস হয়ে গিয়েছে। তা শুনেই দীপ্তির প্রমীলা বাহিনী এসে পুলিশের পথ আটকায়। সেই বাহিনী ঠেকিয়ে দীপ্তির কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে মাদক কারবারিরা পালিয়ে যেত। তা থেকেই পুলিশের সন্দেহ, এলাকার কয়েক জন রিকশাচালক এবং মাদকাসক্তেরা দীপ্তিকে ওই খবর পৌঁছে দিত।
পুলিশ জানিয়েছে, বেশ কিছু দিন ধরেই তাদের কাছে খবর আসছিল, দক্ষিণ শহরতলির ওই এলাকায় প্রায় বিনা বাধায় মাদক ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ছে। সেই সূত্র ধরেই গোয়েন্দারা খোঁজ পান দীপ্তির। এক তদন্তকারী অফিসারের কথায়, ‘‘আমরা দীপ্তির সন্ধান পেলেও জানতে পেরেছিলাম সে নিজের কাছে মাদক রাখে না। পরিচিত কাউকে ছাড়া মাদকও বিক্রি করে না। তা ছাড়া, দীপ্তিকে সব সময়ে ঘিরে রাখে তার ‘প্রমীলা বাহিনী’। তাই তাকে গ্রেফতার করতে নতুন ওই পথ নিতেই হয় আমাদের। যাতে আমাদের সাফল্য মিলেছে।’’
তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, জেরায় ধৃতেরা জানিয়েছে, মূলত চরস এবং হেরোইন বিক্রি করত দীপ্তি এবং তার ছেলে। পুলিশের দাবি, নেপাল থেকে এক আন্তর্জাতিক এজেন্টের মাধ্যমে চরস আসত ওই মহিলা চাঁইয়ের কাছে। চলতি মাসের শুরুতেও একদফা মাদক তার কাছে এসেছিল বলে পুলিশের দাবি। এ ছাড়াও বাংলাদেশ-বনগাঁ সীমান্ত এবং মালদহের কালিয়াচক থেকে হেরোইন পৌঁছে যেত তাদের কাছে।
উল্লেখ্য, শনিবার ওয়াটগঞ্জ থেকে চরস-সহ এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেন নারকোটিক্স শাখার গোয়েন্দারা। ধৃতের নাম, জিতেন্দ্রপ্রসাদ মোদী ওরফে জিতু। তার কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছিল ৫০০ গ্রাম চরস।
লালবাজার সূত্রে খবর, গত মাসেই নাগাল্যান্ডের বাসিন্দা মহম্মদ ইমতিয়াজকে গাঁজা-সহ গ্রেফতার করেছিলেন গোয়েন্দারা। তার সঙ্গে দীপ্তি ও তার ছেলের যোগ আছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তাঁরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy