Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
Nager Bazar blast

সাধারণ সকেটের থেকে কয়েক গুণ বেশি শক্তি ছিল এই বোমার, মত বিশেষজ্ঞদের

ওই অ্যাপার্টমেন্টের প্রোমোটার রণবীর বিশ্বাস। এ দিন ঘটনাস্থলেদাঁড়িয়ে তিনি বলেন,“মাত্র ছ’বছরের পুরনো বাড়ি। এ বাড়িতে আমি নিজেও বাস করি। ভাবুন, কত জোরালো বিস্ফোরণ হলে তবে এ রকমটা হওয়া সম্ভব!”

বিস্ফোরণরে পর ধ্বংসস্তুপ সরাচ্ছেন পুলিশকর্মীরা। -নিজস্ব চিত্র।

বিস্ফোরণরে পর ধ্বংসস্তুপ সরাচ্ছেন পুলিশকর্মীরা। -নিজস্ব চিত্র।

সিজার মণ্ডল
শেষ আপডেট: ০২ অক্টোবর ২০১৮ ১৯:৫৬
Share: Save:

প্রথমে একটা বিকট আওয়াজ। তারই সঙ্গে ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল দরজা-জানলার কাচ। শুধু সীমা অ্যাপার্টমেন্টেরই নয়, আশপাশের প্রায় তিন-চারটি বাড়িরই একই হাল বিস্ফোরণের অভিঘাতে।তার তীব্রতা এতটাই ছিল, সীমা অ্যাপার্টমেন্টের একতলায় যেখানে বিষ্ফোরণ হয়েছে, তার ঠিক উপরে কংক্রিটের কার্নিশের একটা অংশ ভেঙে গিয়েছে।উল্টো দিকের একটি দোকানের শাটারওতুবড়ে ঢুকে গিয়েছেঅনেকটা।

ওই অ্যাপার্টমেন্টের প্রোমোটার রণবীর বিশ্বাস। এ দিন ঘটনাস্থলেদাঁড়িয়ে তিনি বলেন,“মাত্র ছ’বছরের পুরনো বাড়ি। এ বাড়িতে আমি নিজেও বাস করি। ভাবুন, কত জোরালো বিস্ফোরণ হলে তবে এ রকমটা হওয়া সম্ভব!”

মঙ্গলবার যখন নাগেরবাজারের ওই অ্যাপার্টমেন্টের সামনে বিস্ফোরণ হয়, তখন ঘটনাস্থলের কাছেই ছিলেন কাজিপাড়া পুজো কমিটির সম্পাদক পিন্টু দাস। তিনি বলেন,“আওয়াজ এতটাই জোরে হয়েছিল যে, প্রথমে ভেবেছিলাম সামনের উড়ালপুল ভেঙে পড়েছে!”

কী ধরনের বিস্ফোরক ছিল যার তীব্রতা এতটা?

ব্যারাকপুর সিটি পুলিশের কমিশনার রাজেশ কুমার প্রথমে বলেছিলেন, “উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক ছিল ঘটনাস্থলে।”যদিও বিকেলে সেই বয়ান বদলে তিনি বলেন,‘‘লো ইন্টেনসিটি ব্লাস্ট বা কম ক্ষমতাসম্পন্ন সকেট বোমা ফেটেই বিপত্তি।’’তিনি আরও জানান, সিআইডির বিশেষজ্ঞরাফেটে যাওয়া সকেট বোমার অংশ, স্‌প্লিন্টার এবং শার্প নেল উদ্ধার করেছেন।

কী এই সকেট বোমা?

বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ এবং বীরভূমের বিভিন্ন এলাকায় সকেট বোমা ভীষণই পরিচিত। নলকূপের যে পাইপ হয়, আড়াই থেকে তিন ইঞ্চি ব্যাসের ইস্পাতের সেই মোটা পাইপ থেকে চার-ছ’ইঞ্চি মাপে কাটা হয়। এর পর প্যাঁচ তৈরি করা হয়সেই ছোট ছোট পাইপের দু’দিকের মুখে। পাইপের মধ্যে স্‌প্লিন্টার-শ্র্যাপ নেল-সহ শক্তিশালী বোমার মশলা ঢোকানো হয়। এর পর ওই পাইপের দু’দিকের মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়স্টপ কক জাতীয় জিনিস দিয়ে। সাধারণ ভাবে জোরে ছুড়লে সেই সকেট ফাটে।

সিআইডির এক বোমা বিশেষজ্ঞ ঘটনাস্থল থেকে নমুনা সংগ্রহ করার পর বলেন, “বোমাটি বাসন্তী সুইটস-এর বন্ধ গুদামের বাইরে রাখা ছিল। কারণ, বিস্ফোরণের অভিঘাতে শাটার ভেতরের দিকে বেঁকে ঢুকে গিয়েছে। বোমা ভেতরে ফাটলে উল্টোটা হত।”ঠিক একই ভাবে তাঁরা শাটারের ঠিক নীচে মেঝেতে একটি গোল জায়গা চিহ্নিত করেছেন সিআইডি আধিকারিকরা। সেই সঙ্গে ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করেছেন একটি পোড়া চটের ব্যাগ। সিআইডি আধিকারিকদের অনুমান, চটের ব্যাগের মধ্যে লম্বালম্বি ভাবে ওই সকেট বোমাটি রাখা ছিল। সিআইডি আধিকারিকদের একজন ওই গোল চাকতির মতো দাগের ঠিক উপরে শাটারের বেঁকে যাওয়া রড এবং তার উপরে কংক্রিটে দাগ দেখিয়ে বলেন, “বোমাটি ব্যাগে লম্বালম্বি বসানো ছিল। শোয়ানো ছিল না। তাই বিস্ফোরণের অভিঘাতে সেটি উপর দিকে উঠে কংক্রিটে ধাক্কা খেয়ে রাস্তার উল্টোদিকে একটি বন্ধ শাটারে আঘাত করে।” ঘটনাস্থলে পাশাপাশি আরও কয়েকটি শাটারেও শ্র্যাপ নেলের আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।

দেখুন ভিডিয়ো

সিআইডি-র বোমা বিশেষজ্ঞেরা ইম্প্রোভাইসড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি)-এর সম্ভাবনা অনেকটাই উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁদের যুক্তি, যদি আইইডি হত, তাহলে ডিটোনেটর বা টাইমার ডিভাইসের অস্তিত্ব পাওয়া যেত। যেমন, দার্জিলিঙের চকবাজারের নীচে মোটরস্ট্যান্ডেরসামনের বিস্ফোরণস্থলে পাওয়া গিয়েছিল। ওই সিআইডি আধিকারিক বলেন,“দার্জিলিঙে প্রেসারকুকারকে কন্টেনার বা বিস্ফোরকের আধার হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছিল। সেখানে ডিটোনেটর এবং ইলেক্ট্রিক কেবল্‌ পাওয়া যায়। তার থেকেই স্পষ্ট, বাইরে থেকে বিদ্যুৎ দিয়ে বিস্ফোরকটি সক্রিয় করা হয়েছিল।” নাগেরবাজারে সে রকম কিছু পাওয়া যায়নি। আর সেখান থেকেই সিআইডি আধিকারিকদের অনুমান, শক্তিশালী সকেট বোমাই ফেটেছে নাগেরবাজারে।

কী ভাবে ফাটল বোমাটি?

তদন্তাকারীদের অনুমান, চটের ব্যাগে করে সকেট বোমাটি এনে বাসন্তী সুইটস্‌-এর পাশের দোকানের সামনে ফল ব্যবসায়ীঅজিত হালদারের ফলের ডালার পেছনে কেউ রেখে গিয়েছিল। তদন্তকারীদের সন্দেহ, দুর্ঘটনাবশতই ওই বোমা ফেটেছে। কারণ, কেউ বোমাটি ফাটানোর জন্য রাখলে সেটিকে আড়াআড়ি শুইয়ে রাখত, লম্বালম্বি কেউ রাখত না। তাতে অভিঘাত আরও বেশি হয়। তদন্তকারীদের একাংশের অনুমান, না জেনেই হয়তো ফলবিক্রেতা বা অন্য কেউ সেই ব্যাগে চাপ দিয়ে ফেলেন,আর তাতেই বিস্ফোরণ। পাশাপাশি রোদ্দুরের তাপেও বিস্ফোরণের আশঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না তাঁরা।

বোমাটি রেখে গেল কে?

তৃণমূল নেতৃত্ব বিষয়টির পিছনে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র দেখছেন। শাসকদলের একাধিক নেতা বিজেপি-আরএসএস চক্রান্তের অভিযোগ তুলেছেন। রাজ্যের এক মন্ত্রী স্পষ্ট ভাবে দাবি করেছেন, দক্ষিণ দমদমের চেয়ারম্যানকেই মেরে ফেলার ছক কষা হয়েছিল। কিন্তু,পুলিশের প্রাথমিক তদন্ত সেই ষড়যন্ত্রের তত্ত্বকে আদৌ সমর্থন করেছে না। রাজেশ কুমারকে এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন,“কাউকে মারার জন্য এই বোমা রাখা হয়েছিল কি না তা বলা সম্ভব নয়।”

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE