এ-ও এক অন্তরালে থাকার গল্প!
এক সময় কলকাতার পুজোর মণ্ডপে দর্শনার্থীরা ঢুকতেন তাঁদের নামে। পুজো ময়দানে তাঁরা ছিলেন ‘তারকা’। থিমপুজোর বাড়বাড়ন্তে ক্রমেই জৌলুস হারাচ্ছেন মূর্তিশিল্পীরা!
পুজোয় শহরের আনাচ-কানাচ চষে ফেলাকে চলতি কথায় ঠাকুর দেখাই বলে। কোন শিল্পী কোন ক্লাবের ঠাকুর গড়ছেন, তার উপরেই নির্ভর করত ভিড়ভাগ্য। শহরের প্রবীণ পুজোকর্তারা বলছেন, পঞ্চাশ-সত্তরের দশকে পুজো ময়দানে তারকা ছিলেন জিতেন পাল, রমেশ পাল, মোহনবাঁশি রুদ্রপাল। পরের দিকে তালিকায় আসেন জিতেনপুত্র কার্তিক পালও। সে সময় পুজো কমিটিগুলিও মণ্ডপ ছেড়ে ঠাকুরের উপরেই জোর দিত। উত্তর ও মধ্য কলকাতার কলেজ স্কোয়্যার, ফায়ার ব্রিগেড কিংবা দক্ষিণের সঙ্ঘশ্রী, মুক্তদল, সঙ্ঘমিত্র, ২৩ পল্লির ঠাকুর কুমোরটুলি থেকে বেরোনোর দিনই শুরু হত উন্মাদনাটা।
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থিমপুজো শুরু হওয়া ইস্তক বদলে যায় ছবি। প্রতিমা থেকে নজর ঘোরে মণ্ডপে। বদলায় প্রতিমার ধরন।
পুজো ময়দান অবশ্য বলছে, ধরন-উন্মাদনা যতই বদলাক, এখনও কিন্তু প্রতিমার দখলে রেখেছে ‘পাল’ উত্তরসূরীরাই। থিমের বাজারেও শহরের নামী পুজোয় প্রতিমা গড়ছেন কুমোরটুলির সেই বংশধরেরা।
বংশানুক্রমে বাগবাজার সর্বজনীনের প্রতিমা গড়ার দায়িত্বে নব পাল। তবে কলকাতার সেরা সাবেকি প্রতিমার পাশাপাশি থিম পুজোতেও সমান ভাবে নজর কাড়ছেন তিনি। এ বছরও সুরুচি সঙ্ঘ, তেলেঙ্গাবাগান, কাশী বোস লেন, দমদম পার্ক যুবকবৃন্দের প্রতিমার দায়িত্ব তাঁর হাতে। তিনি বলছেন, ‘‘সাবেকি ঠাকুর গড়া আমাদের রক্তে। কাঠামো বাঁধা থেকে চক্ষুদান, কবে কী হবে তা নিয়ে ভাবতে হয় না। কিন্তু থিমের ঠাকুর গড়া চ্যালেঞ্জ। গড়ার পথেই নানা বদল আনতে হয়।’’ শহরের আরও এক মৃৎশিল্পী পরিমল পালের হাতে এ বার শিকদারবাগান, খিদিরপুর ২৫ পল্লি, পল্লিমঙ্গল, বেহালা মিত্র সঙ্ঘ-সহ শহরের ১১টি পুজোর প্রতিমার ভার। পুজো ময়দানের কর্তারা বলছেন, এমন অনেক শিল্পীই আছেন, যাঁরা থিমের ভার নিলেও প্রতিমা গড়ার দায়িত্ব দেন পরিমলকে। এমনও হয়েছে যে, থিমশিল্পী নজর কাড়তে পারেননি কিন্তু পরিমলের প্রতিমা আমজনতা থেকে শিল্পবোদ্ধার, সবার তারিফ কুড়িয়েছে। পুজোর বাজারে নজর কাড়ছেন প্রতিমাশিল্পী সৌমেন পালও। পুজোকর্তারা বলছেন, উৎসব কাপে এমন অন্তরালে থাকা মৃৎশিল্পী অনেকেই আছেন। এ-ও শোনা যায়, এই সব শিল্পীদের থেকে মূর্তি কিনে কেউ কেউ নিজের নাম চালিয়ে দেন।
থিমের বাজার যে একেবারে প্রতিমাশিল্পী দেয়নি এমনটা নয়। থিম পুজোর গো়ড়ার দিকে অমর সরকার-ভবতোষ সুতার জুটি অনেকের নজর কেড়েছিল। তখন অমর দেখতেন মণ্ডপ আর ভবতোষ প্রতিমা দেখতেন। পরে একক থিমশিল্পী হিসেবে খ্যাত হলেও ভবতোষ প্রতিমার দায়িত্ব অন্য কাউকে দেননি। প্রতিমাতেও নিজের ঘরানা তৈরি করেছেন। আরও এক খ্যাতনামা থিমশিল্পী সনাতন দিন্দারও প্রতিমা তৈরিতে সুনাম রয়েছে। তাঁর গড়া মূর্তিতেও নিজস্বতা থাকে।
এই ঘরানার কথা তুলতেই শহরের প্রবীণ পুজোকর্তা দেবাশিস সেনগুপ্ত ডুবে যান পুরনো দিনে। বলেন, ‘‘চোখ দিয়েই চেনা যেত প্রতিমার স্রষ্টাকে। রমেশ পালের ঠাকুরের চোখ হতো ‘রণং দেহি’। তেজ যেন ঠিকরে বেরোত। জিতেন পালের প্রতিমার চোখ মায়ের মতো মমতাময়ী! এ সবের থেকে আলাদা মোহনবাঁশি রুদ্রপাল। তেজ ও মায়ার অদ্ভূত মিশেল।’’ কলকাতার পুজোর প্রথম বদলও কুমোরটুলির হাতেই! গোপেশ্বর পালই তো একচালা থেকে আলাদা করে পাঁচচালা মূর্তির স্রষ্টা।
এত কিছুর পরেও প্রতিমাশিল্পীদের অনেকের আক্ষেপ, বাকি থিমশিল্পীদের আড়ালে ঢাকা পড়ে থাকেন তাঁরা। সেই আক্ষেপে সমর্থন জোগাচ্ছেন নামী শিল্পীদের অনেকেই। ভবতোষের প্রতিমা গড়ার অনুপ্রেরণা তরুণ দে। প্রবীণ এই শিল্পীর কথায়, ‘‘ঠিক মতো থিম পুজো করতে গেলে প্রতিমা ও মণ্ডপে সামঞ্জস্য থাকতে হবে। যে শিল্পীরা নিজেরা প্রতিমা গড়তে পারেন না, তাঁদের নির্ভর করতে হয় মৃৎশিল্পীদের উপরে। অথচ মৃৎশিল্পীরা কদর পান না।’’ তরুণবাবু এ বার আরও এক শিষ্য প্রদীপ দাসের সঙ্গে বেহালার নেতাজি স্পোর্টিং ক্লাবের প্রতিমা গড়ছেন। আর্ট কলেজে ভাস্কর্যের পাঠ নেওয়া জিতেন-পৌত্র নব অবশ্য এ সব আক্ষেপ নিয়ে ভাবতে নারাজ। বলছেন, ‘‘১৯৯৭ সাল থেকে থিমের ঠাকুর গড়ছি। এ সব নিয়ে ভাবি না।’’ তাঁর পাল্টা চ্যালেঞ্জ, ‘‘থিমের বাজার বদলে গেলে শিল্পীরা চাপে পড়বেন। প্রতিমা ছাড়া কিন্তু পুজো হবে না।’’
তবে ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছেন এই সব ‘মাটির মানুষ’। পরিমল যেমন গত কয়েক বছর ধরেই থিমের কাজ করছিলেন। এ বারও সল্টলেকের একটি পুজোয় থিম গড়ছেন তিনি। এ বারই প্রথম থিমে হাত দিয়েছেন নব। শোভাবাজার সংগ্রামীর পুজোয় থিমের দায়িত্বে তিনি।
আগামী দিনে কি তা হলে অন্তরাল থেকে বেরিয়ে আসার গল্প শোনা যাবে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy