ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
পুব আকাশে আলোর রেখা ফোটার আগেই এ পাড়ার ঘুম ভাঙে আজানের সুরে। আবার সন্ধ্যা হতেই দূরের মন্দির থেকে ভেসে আসা কাঁসর-ঘণ্টা আর শঙ্খধ্বনি এ পাড়ার সম্প্রীতি ঘোষণা করে। এক মিশ্র সংস্কৃতি আর জীবনযাত্রার বৈচিত্র আমাদের পাড়া সুন্দরীমোহন অ্যাভিনিউর নিজস্ব চরিত্র।
ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে পাখিদের কলরব, দু’-একটি চায়ের দোকান থেকে ভেসে আসা প্রাদেশিক সঙ্গীতের সুর আর স্বাস্থ্য সচেতন নাগরিকদের প্রাতর্ভ্রমণ ভোরের পরিচিত ছবি। অবশ্য বেলা বাড়তেই বদলে যায় সকালের সেই শান্ত, স্নিগ্ধ ছবিটা। বাড়তে থাকে যান-বাহনের তীব্র কর্কশ হর্নের আওয়াজ। সেই আওয়াজেই ঢেকে যায় ফেরিওয়ালার ডাক আর রাস্তার নানা পরিচিত আওয়াজ। তবু বলব, আমাদের পাড়াটা শান্তিপূর্ণ, নির্ঝঞ্ঝাট। ননীগোপাল রায়চৌধুরী অ্যাভিনিউ থেকে শুরু করে সুন্দরীমোহন অ্যাভিনিউ, রামেশ্বর শাহ রোডে গিয়ে মিশেছে। পাশেই সুরেশ সরকার রোড, ও পাশে লিন্টন স্ট্রিট।
এক কালের বাঙালি পাড়াটায় এখন অবাঙালিদের সংখ্যাই বেশি। একে একে বাঙালি পরিবারগুলি অন্যত্র চলে গিয়েছে। পুরনো প্রতিবেশীদের অভাব আজও অনুভব করি। পরিবর্তে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেলাম কই? নতুনরা বেশির ভাগই অবাঙালি হওয়ায় ভাষার পার্থক্য মিলমিশের ক্ষেত্রে কোথায় যেন একটা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর পুরনো বাসিন্দা যাঁরা এখনও আছেন, তাঁরাও নিজের মতোই থাকতে পছন্দ করেন। সময়ের সঙ্গে জীবনযাত্রায় গ্রাস
করেছে আত্মকেন্দ্রিকতা।
মনে পড়ে, এ অঞ্চলের প্রখ্যাত চিকিৎসক শান্তিরঞ্জন পালিতের কথা। আগে তাঁর বাড়িটাই পাড়ায় সবচেয়ে উঁচু বাড়ি ছিল। তিনি সকলের খোঁজখবরও যেমন রাখতেন, তেমনই বিপদ-আপদে সাহায্যের হাতও বাড়িয়ে দিতেন। ছোটদের নিয়ে তিনি আয়োজন করতেন বসন্ত উৎসবের। সে সব আজ স্মৃতি।
এক-এক সময়ে মনে হয় এখন পাড়াটা শুধু মাত্র একটা থাকার জায়গা হয়ে গিয়েছে। তাঁর সঙ্গে দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় যোগাযোগ, অন্তরঙ্গতা কবেই হারিয়েছে। কমেছে মানুষে মানুষে যোগাযোগ, দেখা সাক্ষাৎ। একে অপেরর বাড়িতে যাওয়ার অভ্যাসটাও কমেছে। এখন রাস্তায় দেখাসাক্ষাৎ হলে উপর উপর সৌজন্য বিনিময়টুকু সেরে যে যার মতো এগিয়ে চলেন।
অন্যান্য পাড়ার মতো এ পাড়ায় কখনও রকের আড্ডা চোখে পড়েনি। তবে আড্ডার পরিবেশ ছিল। সেটা এখনও আছে পাড়ার চায়ের দোকানে আর মোড়ের মাথায়। ছুটির দিনে আড্ডার ঝলক বেশি চোখে পড়ে। পাড়ার মুখেই দু’টি দোকানে কচুরি, শিঙাড়া, জিলিপি কিনতে ভিড় করেন বহু মানুষ। সেখানেই আড্ডা চলে।
পঞ্চান্ন বছর ধরে এ এলাকায় বসবাস। তখন থেকে আজ পর্যন্ত অনেক বদলেছে আমাদের পাড়া। উন্নতির কথাই যদি বলি, এখন দিনে দু’বার রাস্তা পরিষ্কার করা হয়। আগের চেয়ে বসেছে জোরালো আলো, তাই রাতেও পাড়াটা বেশ উজ্জ্বল থাকে। তবে পুরসভা এলাকা পরিচ্ছন্ন রাখাতে চেষ্টা করলেও, স্থানীয়দের মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে। এ জন্য এক এক সময় পাড়াটা হতশ্রী চেহারা ধারণ করে। আগে পাড়া এবং আশপাশেরঅঞ্চলে গাছগাছালি ছিল। সময়ের সঙ্গে সেটাও কমেছে।
এ অঞ্চলে বাড়তে থাকা জমি ও ফ্ল্যাটের দামের জন্য এখানে আর্থিক সঙ্গতিপন্ন অবাঙালিরা আসছেন এখানে থাকতে। একে একে পুরনো বাড়িগুলি ভেঙে তৈরি হচ্ছে বহুতল। দেখতে দেখতে পরিচিত পাড়াটাই কেমন যেন অপরিচিত হয়ে উঠছে।
আগে পাড়ার মধ্যে এত যান চলাচল ছিল না। তাই ছোটরা মনের সুখে রাস্তায় খেলত। আজ ছবিটা বদলেছে। তবে এখনও কাছাকাছি পার্কগুলিতে ছোটদের খেলতে দেখা যায়। অনেক বদলালেও হারায়নি পাড়ার পুজোর আকর্ষণটা। পুজোর ক’টা দিন পাড়াটা আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। তেমনই এ পাড়ার ইদ ও মহরমও সমান আকর্ষণীয়। এ পাড়ায় হিন্দু-মুসলমান একে অপরের সুখ-দুঃখে পাশাপাশি থাকে।
আগে যুব সম্প্রদায় পাড়াতেই থাকত। এখন ছবিটা ভিন্ন। তাঁরা অধিকাংশই উচ্চ শিক্ষা কিংবা কর্ম সূত্রে কলকাতার বাইরে। এ জন্য পাড়াটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে।
এত বছর এখানে কাটিয়ে মায়ায় জড়িয়ে পড়েছি। তাই সুযোগ এলেও পাড়াটাকে ছেড়ে যেতে মন চায় না। সুখে-দুঃখে এখানেই বেশ আছি।
লেখক প্রবীণ সঙ্গীতশিল্পী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy