আগুন লাগার পর বাইরে আসার চেষ্টা করছেন হাসপাতালের কর্মীরা। সোমবার সুদীপ্ত ভৌমিকের তোলা ছবি।
কাজের দিনে ভিড়ে ঠাসা এসএসকেএম হাসপাতাল। হঠাৎ দেখা গেল, রোনাল্ড রস বিল্ডিংয়ের সাততলা থেকে গলগল করে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। সোমবার বেলা সওয়া ১১টা নাগাদ আগুন লাগার এই ঘটনা টের পেয়েই সঙ্গে সঙ্গে খবর দেওয়া হয় দমকলে। বার করে আনা হয় সেখানে থাকা রোগীদের। ১৯টি ইঞ্জিন ঘণ্টাখানেকের চেষ্টায় আগুন নেভায়। এই ঘটনায় কেউ হতাহতও হননি। প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছে, সাততলায় গ্রন্থাগারের পাশে টেলিকম সংস্থার সার্ভার রয়েছে। সেখান থেকেই আগুন লাগে। এটি নিছক দুর্ঘটনা নাকি অন্তর্ঘাত, তা তদন্ত করে দেখা হবে বলে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একই সঙ্গে স্বাস্থ্য দফতরকেও তদন্তের নির্দেশ দেন তিনি। পাশাপাশি তিনি জানিয়েছেন, এ বার থেকে দমকলের হাইড্রলিক মই-সহ দু’টি ইঞ্জিন সেখানে সর্বক্ষণের জন্য মোতায়েন করা হবে। বিকেলে ঘটনাস্থলে যান ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞেরাও।
এ দিন দমকলের কর্মীরা পৌঁছেই রোনাল্ড রস বিল্ডিংয়ের নীচে দাঁড়ানো ইঞ্জিন পাইপ টেনে নিয়ে লাইব্রেরিতে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করেন। এ জে সি বসু রোড উড়ালপুলের উপরে দমকলের গাড়ি দাঁড় করিয়েও জল ছেটানোর কাজ শুরু হয়। এসএসকেএম-রবীন্দ্র সদন চত্বরের মতো ব্যস্ত এলাকার যান চলাচল নিয়ন্ত্রণে নেমে পড়েন পুলিশকর্মীরা। রোগীর পরিজনদের পাশাপাশি হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স, চতুর্থ শ্রেণির কর্মীরাও উদ্ধারকাজে তৎপর হয়েছিলেন। কাজ তত্ত্বাবধানে নেমে পড়েন হাসপাতালের রোগীকল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান তথা রাজ্যের পূর্তমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসও। বার্ন, প্লাস্টিক সার্জারি ও লাইগেশন ওয়ার্ডের মোট ৭৪ জন রোগীকে নিরাপদে বার করে আনা হয়। পরে রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তা মন্তব্য করেন, ‘‘টিম এসএসকেএমের জন্যই এ দিন বড় বিপদ এড়ানো গিয়েছে।’’
২০১১ সালে আমরি হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ডের সাক্ষী ছিল এই শহর। গত অগস্টে বহরমপুর মেডিক্যাল কলেজেও আগুনে তিন জনের মৃত্যু হয়। গত ২৩ সেপ্টেম্বর রোনাল্ড রস বিল্ডিংয়ের অদূরেই একটি বিদ্যুতের বক্সে আগুন লাগে। হাসপাতালের এক সূত্রের দাবি, গত ছ’মাসে তিনটি ছোট আগুনের ঘটনা ঘটেছে। এ দিন ফের আগুন লাগায় তাই হাসপাতালের অগ্নিসুরক্ষা ব্যবস্থা এবং দমকলের পরিকাঠামো নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
দমকল না হয় থাকবে, কিন্তু হাসপাতালের মতো জায়গায় আগুন লাগলে কী সমস্যা হয়, তার সাক্ষী থেকেছেন ডাক্তার, রোগী ও পরিজনেরা। রোনাল্ড রস বিল্ডিংয়ের দোতলায় অর্থোপে়ডিক আউটডোর চলে। তিনতলায় বার্ন ইউনিট ও ডাক্তারদের ঘর। চারতলায় লাইগেশন ওয়ার্ড। পাঁচতলায় মে়ডিসিন, গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজি ও এন্ডোক্রিনোলজির ডাক্তারদের ঘর। ছ’তলায় প্লাস্টিক সার্জারির ওটি ও ওয়ার্ড। সাততলায় লাইব্রেরি ও সার্ভার রুম। হাসপাতাল সূত্রের খবর, এ দিন সকালে প্লাস্টিক সার্জারি অপারেশন শুরু হয়েছিল। এমন সময়েই আগুন লাগে। অপারেশন থিয়েটারে থাকা রোগীদের তড়িঘড়ি বার করে আনা হয়। তেমনই এক রোগী কোচবিহারের সুদীপ বিশ্বাস। তাঁর আত্মীয় উত্তম বর্মণ জানান, সুদীপকে অজ্ঞান করে অস্ত্রোপচার শুরু হয়। এমন সময়েই আগুন লাগার খবর পাওয়া যায়। অস্ত্রোপচার স্থগিত রেখে তড়িঘড়ি সুদীপের জ্ঞান ফেরান চিকিৎসকেরা। তার পরে তাঁকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় অ্যাকাডেমিক বিল্ডিংয়ে।
মুর্শিদাবাদের বছর চারেকের তন্ময় মাঝি, সিউড়ির বছর দশেকের লাবণী কোড়াও ভর্তি ছিল প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগে। আগুন লাগার পরেই তাদের মায়েরা নামিয়ে আনেন নীচে। চেস্ট মেডিসিন বিভাগের সামনে দাঁড়িয়ে লাবণীর মা পার্বতী কোড়া বলছিলেন, ‘‘জামাকাপড়, ডাক্তারি পরীক্ষার রিপোর্ট কিছুই আনতে পারিনি। দেখি কখন আবার ভিতরে ঢুকতে দেয়!’’
দমকল সূত্রের খবর, উত্তুরে হাওয়ার ধাক্কায় এ দিন রোনাল্ড রস বিল্ডিংয়ের ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে অন্য বাড়িতেও। সেখানে থাকা রোগীদের মধ্যেও আতঙ্ক ছড়ায়। ভয়ে নেমে এসে নবজাতকদের কোলে আঁকড়ে হরিশ মুখার্জি রোডের ফুটপাথে বসে থাকতে দেখা যায় বহু প্রসূতিকে। তাঁদেরই এক জন মানসী মান্না। দিন কয়েক আগে সন্তান হয়েছে। কাল, বুধবার তাঁর সেলাই কাটার কথা। ছুটি মিলবে তার পরে। কিন্তু আগুন আতঙ্কে সদ্যোজাত সন্তানকে নিয়ে হাসপাতালে ফিরতে চাইছিলেন না তিনি। মানসীর মায়ের আক্ষেপ, ‘‘সেলাই না কেটে ফিরে গেলে তো ওরই ক্ষতি। কিন্তু মেয়ে কিছুতেই বুঝতে চাইছে না!’’
শনিবার জরায়ুর টিউমার অস্ত্রোপচার হয় ধুলিয়ানের কাশমুর বিবির। এ দিন আগুন লাগার খবর শুনেও বেড ছেড়ে নামার অবস্থা ছিল না তাঁর। কাশমুরের ছেলে আসমাউল শেখ বলছিলেন, ‘‘মা নামতে পারবে না জেনে আমিই দৌড়ে উপরে যাই। মাকে বোঝাই, এই বাড়িতে আগুন লাগেনি। তুমি ভয় পেয়ো না।’’ রোনাল্ড রস বিল্ডিংয়ের পাশের বাড়িতে কার্ডিওথোরাসিক বিভাগে ভর্তি ছিলেন হাওড়ার পোঁদরার গৃহবধূ প্রীতি বিশ্বাস। সদ্য হার্টের ভাল্ভ অপারেশন হয়েছে তাঁর। আগুন লেগেছে শুনেই নীচে অপেক্ষারত প্রীতির মা ভারতী মাজি দৌড়ে মেয়ের কাছে যাচ্ছিলেন। নিরাপত্তারক্ষীরা আটকালে তিনি চেঁচাতে শুরু করেন, ‘‘এখানে থাকলে মেয়ে মরে যাবে। আমি যাবই।’’ তার পরেই কার্যত রক্ষীদের ধাক্কা মেরে ভিতরে ঢোকেন এবং নাকে অক্সিজেনের মুখোশ পড়া মেয়েকে লিফ্টে নামিয়ে আনেন। বাইপাস অপারেশন হওয়া টগরি বিবিও আগুন আতঙ্কে ওয়ার্ড ছেড়ে নেমে এসেছিলেন। তাঁর পরিবারের লোকেরা জানান, এ দিন সকালেই আইসিইউ থেকে জেনারেল বেডে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল টগরিকে।
চোখের সামনে দাউদাউ আগুন। সোমবার, এসএসকেএম হাসপাতালে। ছবি: রণজিৎ নন্দী
এসএসকেএমে আগুন লাগার ঘটনা শুনে প্রশাসনের কর্তারা ঘটনাস্থলে ছোটেন। বেলা ১১টা ৫০ নাগাদ ছ’টি গাড়ির কনভয় নিয়ে ঘটনাস্থলের কাছে পৌঁছন মেয়র এবং দমকলমন্ত্রী শোভন চট্টোপাধ্যায়। কালীঘাটের বাড়ি থেকে বেরিয়ে দুপুর ১২টা নাগাদ সোজা এসএসকেএমে যান মুখ্যমন্ত্রী। পোস্টঅফিস গেটের সামনে তিনি গাড়ি থেকে নামতেই অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (১) বিনীত গোয়েল এবং ডিসি (সাউথ) মুরলীধর শর্মা তাঁকে জানান, লাইব্রেরিতে আগুন লেগেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে। কোনও রোগী ভিতরে আটকে নেই। তা শুনেই মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘কেউ লাগিয়েছে ওই আগুন। তোমরা ঘটনাস্থলে যাও।’’ এর পরে ভিড়ে না গিয়ে উডবার্ন ওয়ার্ডের সামনে গিয়ে দাঁড়ান মুখ্যমন্ত্রী।
হাসপাতালে দমকলমন্ত্রী শোভন চট্টোপাধ্যায় এবং পুলিশকর্তাদের সঙ্গে কথা বলার পরে মুখ্যমন্ত্রী জানান, কেন আগুন লেগেছে, তা তদন্ত করে দেখা হবে। আদৌ লেগেছে নাকি লাগানো হয়েছে, সে দিকটাও দেখা হবে। তাঁর কথায়, ‘‘পুলিশ, দমকল, স্বাস্থ্য দফতর একসঙ্গে তদন্ত করবে। আগুনের জন্য কে দায়ী, সব দেখা হবে।’’ আগুন নেভার পরে সাততলায় গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অংশ খতিয়ে দেখেন অরূপবাবুও। ঘটনা এবং তদন্ত নিয়ে তাঁর গলাতেও মুখ্যমন্ত্রীরই সুর। তা নিয়েই প্রশ্ন তুলছেন বিরোধীরা। প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি অধীর চৌধুরী এ দিন বলেন, ‘‘রাজ্যে আগুন লাগার ঘটনা বাড়ছে। বহরমপুর মেডিক্যাল কলেজে আগুন লাগার পরে দিদি অন্তর্ঘাত বলেছিলেন। এ বারও কি বলবেন? বাংলার হাসপাতাল মা-মাটি-মানুষের সৌজন্যে জতুগৃহে পরিণত হয়েছে।’’
বিকেলে ঘটনাস্থলে যান বিজেপি সাংসদ রূপা গঙ্গোপাধ্যায় ও নেত্রী লকেট চট্টোপাধ্যায়। পরিকাঠামোর অভাবের অভিযোগ করে রূপা বলেন, ‘‘অগ্নিকাণ্ডের নিরপেক্ষ তদন্ত ও দোষীদের শাস্তি দাবি করছি।’’ আর লকেটের বক্তব্য, ‘‘লাইব্রেরিতে কালো টাকা পোড়ানো হয়েছে। তাই তদন্ত হবে না। হাসপাতালের কর্তারাই বলেছেন যে লাইব্রেরিতে আলো, পাখা, এসি চলছিল না। তা হলে আগুন লাগল কী ভাবে?’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy