রোজনামচা: ব্যস্ততায় মশগুল। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী
সাবেক রাজপথের অন্তহীন কোলাহল, টানা রিকশার শব্দ, ফেরিওয়ালার ডাক আর নতুন-পুরনো বাড়ি দু’পাশে রেখে এগিয়েছে বৃন্দাবন বসাক স্ট্রিট। রবীন্দ্র সরণি থেকে এই রাস্তা মিশেছে গৌর লাহা স্ট্রিটে, পাশে নিমু গোস্বামী লেন। ও দিকে বাবুরাম ঘোষ লেন মিশেছে বি কে পাল অ্যাভিনিউতে। এখানে দিব্যি বহাল উত্তুরে সংস্কৃতি।
প্রায় দেড়শো বছর এ পাড়ায় বাস। ছোটবেলায় পাড়াটা ছিল অনেক ফাঁকা। তখন বাঙালি ছিল বেশি। এখন অবাঙালি পরিবারের ভিড় এখানে। এখনও তৈরি হয়নি বহুতল। আজও চোখে পড়ে কাচ ঢাকা ঝোলা বারান্দা আর থামওয়ালা বাড়ি। পুরনো প্রতিবেশীদের আজও সুখ-দুঃখে, বিপদ-আপদে পাশেই পাওয়া যায়।
এখনও কোনও সমস্যায় কাউকে ডাকতে হয় না। নিজে থেকেই পড়শিরা সাহায্যের হাত বাড়ান। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে একটা ঘটনা। এক বার আমার বাবা যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন আমি কর্মসূত্রে তখন বাইরে। বাড়িতে মা একা। পাড়া-পড়শিরাই তখন যা যা করণীয়, সবের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এমনটা কী সব পাড়ায় হয়? আমার অন্তত জানা নেই। এ পাড়ায় রয়েছে এক নিশ্চিন্ত নিরাপত্তা এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশ। পাড়ার মধ্যেই রয়েছে একটা বস্তি। সময়ের সঙ্গে তার রূপ বদলেছে। বস্তির বাসিন্দাদের সঙ্গেও আমাদের সুসম্পর্ক রয়েছে।
এ পাড়ার সকালটা শুরু হয় নামসংকীর্তনে। এক দল মানুষ নাম গান করতে করতে নিয়মিত গঙ্গাস্নানে যান। বেলা বাড়তে কিছু মানুষ জড়ো হন মাধাইয়ের চায়ের দোকানে। খবরের কাগজটায় চোখ বুলিয়ে চলে ক্ষণিকের আড্ডা। নানা পরিবর্তনের মাঝে হারায়নি এ পাড়ার আড্ডা সংস্কৃতি। আর আড্ডাটা আছে বলেই সকলের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। তবে অতীতের রকগুলো আজ আর নেই। নানা কারণে সেগুলি ঘিরে ফেলা হয়েছে। এখন কখনও বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কখনও বা মাধাইয়ে চায়ের দোকানেই বসে আড্ডা। রাজনীতি থেকে খেলাধুলো, সব নিয়েই জমে দেদার তর্ক-বিতর্ক। তবু ভুলবোঝাবুঝি নেই! এমনই এ আড্ডার মাহাত্ম্য।
কমেছে পাড়ার খেলাধুলোর চলটা। ছুটির দিনে কচিকাঁচারা গলিতে ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন খেললেও নিয়মিত খেলাধুলোর ছবিটা আর চোখে পড়ে না। এখন বছরে এক বার হয় ফুটবল টুর্নামেন্ট। কাছাকাছি মাঠ থাকলেও খেলার আগ্রহটাও আগের চেয়ে কমেছে। নতুন প্রজন্মের মধ্যে পাড়ার ব্যাপারে একটা যেন গা ছাড়া মনোভাব চোখে পড়ে। এটা কষ্ট দেয়। পাড়ার ভাল-মন্দ বিষয়ে তারা কেন জানি না বেশ উদাসীন। অথচ বছর দশেক আগেও যুব সম্প্রদায় পাড়াটার ভাল-মন্দ নিয়ে ভাবনা চিন্তা করত।
অন্যান্য পাড়ার মতো এখানেও মিলছে পর্যাপ্ত নাগরিক পরিষেবা। নিয়ম করে রাস্তা পরিষ্কার আর জঞ্জাল সাফাই হলেও কিছু মানুষের নাগরিক সচেতনার অভাবে পাড়াটা মাঝেমাঝে নোংরা হয়। জানি না এ ব্যাপারে সচেতনতা কবে আসবে?
পাড়ার মুখেই রয়েছে নানা মনীষীর স্মৃতিধন্য ওরিয়েন্টাল সেমিনারি। এ দিকে রাস্তা পেরোলে গরানহাটায় রয়েছে সোনা-রুপোর দোকান। অন্যান্য পাড়ার মতো এখানকার পুজো-পার্বণও আকর্ষণীয়। চৈত্র মাসে ধুমধাম করে হয় শীতলা পুজো। এই উপলক্ষে অতীতে আসত নাম করা যাত্রার দল। সেই নিয়ে পাড়ার মানুষের উৎসাহ কম ছিল না। এ ছাড়াও হয় দুর্গাপুজো, কালীপুজো এবং জগদ্ধাত্রীপুজো।
পাড়াটার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িয়ে আছে কিছু ফেরিওয়ালার ডাক। গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় আসে কুলফিমালাইওয়ালা, আঠারো-ভাজা আর সেই ঘুগনিওয়ালার ঘুগনির স্বাদ আজও অপরিবর্তিত রয়েছে। কাছাকাছি রয়েছে বিখ্যাত কিছু মিষ্টির দোকানও।
পাড়ার একে বারে শেষ প্রান্তে রয়েছে ভূত গলি। এক কালে সেখানে ছিল একটি পোড়ো বাড়ি। ছেলেবেলায় আমারা ওই গলির ত্রিসীমানায় যেতাম না। তাই নামটা আজও অপরিবর্তিত রয়ে গিয়েছে। এখন বিশ্বকর্মা পুজোর দিন ছাদে উঠে আকাশটাকে দেখে কষ্ট হয়। সেই আকাশ ভরা ঘুড়ি আজ কোথায়? তেমনই কালীপুজোর সন্ধ্যায় আকাশটা ভরে যেত রং বেরঙের নানা ধরনের বাড়িতে তৈরি ফানুসে। অবশ্য গত কয়েক বছরে তার বিকল্প হিসেবে এসেছে চিনে তৈরি ছোট ছোট ফানুস।
কিছু পরিবর্তন, কিছু প্রাপ্তির মাঝে এখানেই আছে শান্তি আর নিশ্চিত নিরাপত্তা। তাই এ পাড়া ছেড়ে অন্যত্র আর কোথায় যাব?
লেখক সরকারিকর্মী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy