Advertisement
০৪ মে ২০২৪
Dhakuria School

‘ধর ধর..., শাড়ি ছিঁড়ে দে!’

অভিভাবকদের একাংশের দাদাগিরির সাক্ষী থাকল এ শহর। স্কুল থেকে কয়েক হাত দূরে শ্যামলীদেবীকে এবং ঢাকুরিয়া স্টেশনে রূপা ভট্টাচার্য নামে আর এক শিক্ষিকাকে শারীরিক ভাবে হেনস্থার অভিযোগ উঠেছে অভিভাবকদের বিরুদ্ধে।

নিন্দনীয়: এ ভাবেই হেনস্থা করা হচ্ছে শ্যামলীদেবীকে। ছিঁড়ে দেওয়া হচ্ছে তাঁর পোশাক। মঙ্গলবার, ঢাকুরিয়ায়। ছবি: সুপ্রিয় তরফদার

নিন্দনীয়: এ ভাবেই হেনস্থা করা হচ্ছে শ্যামলীদেবীকে। ছিঁড়ে দেওয়া হচ্ছে তাঁর পোশাক। মঙ্গলবার, ঢাকুরিয়ায়। ছবি: সুপ্রিয় তরফদার

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০১৮ ০১:৩৩
Share: Save:

রাস্তা দিয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে শিক্ষিকারা কার্যত বাঁচতে চাইছেন। পিছনে তাঁদের দিকে তেড়ে আসছেন একদল মহিলা ও পুরুষ। শিক্ষিকাদের দিকে একনাগাড়ে ধেয়ে আসছে অশ্রাব্য গালিগালাজ। ওই দল থেকে এক যুবক চিৎকার করে বললেন, ‘‘কাউকে ছাড়ব না। ধর ওদের। টান, টান, শাড়ি ধরে টান।’’ তার পরেই এক মহিলা পিছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন এক শিক্ষিকার উপরে। তাঁর ব্লাউজের একাংশ গেল ছিঁড়ে। পাশের এক মহিলা বলতে থাকেন, ‘‘শাড়ি ছিঁড়ে দে ...দের।’’ রাস্তার মধ্যে কেউ ওই শিক্ষিকার কাপড় ধরে টান মারেন। কেউ বা হাত ধরে টেনে মাটিতে ফেলার চেষ্টা করতে থাকেন। সেই সঙ্গে চলতে থাকে এলোপাথাড়ি চড়থাপ্পড়। পরে দু’জন ছাত্রী এসে কোনও ভাবে ওই শিক্ষিকা শ্যামলী চৌধুরীকে স্কুলের ভিতরে নিয়ে যায়। আতঙ্কে কাঁদতে থাকেন তিনি।

মঙ্গলবার ঢাকুরিয়ার বিনোদিনী গার্লস হাইস্কুলের সামনে অভূতপূর্ব এই দৃশ্য দেখে হতবাক এলাকার বাসিন্দারাও। ওই স্কুলে প্রাক্-প্রাথমিকের এক ছাত্রীকে যৌন হেনস্থার অভিযোগ ওঠে এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই এ দিন অভিভাবকদের একাংশের দাদাগিরির সাক্ষী থাকল এ শহর। স্কুল থেকে কয়েক হাত দূরে শ্যামলীদেবীকে এবং ঢাকুরিয়া স্টেশনে রূপা ভট্টাচার্য নামে আর এক শিক্ষিকাকে শারীরিক ভাবে হেনস্থার অভিযোগ উঠেছে অভিভাবকদের বিরুদ্ধে।

স্কুলের শিক্ষিকাদের অভিযোগ, গালিগালাজ করা থেকে পোশাক ছিঁড়ে দেওয়া, এমনকি স্কুল বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি— কিছুই প্রায় বাদ রাখেননি মারমুখী অভিভাবকেরা। যদিও স্কুলশিক্ষা দফতর জানিয়েছে, বহু বহিরাগত ওই দলে এ দিন ঢুকে পড়েছিল। পঞ্চাননতলা বস্তির বাসিন্দাদের একাংশও ওই দলে ছিলেন বলে তাদের অনুমান।

এ দিন শ্যামলীদেবীকে যাঁরা হেনস্থা করেন, তাঁদের দলে পিঠে ব্যাগ নেওয়া এক যুবককে দেখে সন্দেহ হওয়ায় তাঁর পরিচয় জানতে চাওয়া হয়। কিন্তু কোনও উত্তর না দিয়েই পালিয়ে যান তিনি। তাঁর কোনও পরিচিত ওই স্কুলে পড়ে কি না, সেটাও বলতে চাননি তিনি। তার পরে আর ঘটনাস্থলে দেখা যায়নি ওই যুবককে।

এ দিন সকাল থেকেই দফায় দফায় স্কুলের সামনে ভিড় জমান অভিভাবকেরা। প্রথম দিকে পুলিশকর্মীরা সংখ্যায় কম থাকায় অভিভাবকেরা স্কুলের ভিতরে ঢুকে ভাঙচুর চালান বলে অভিযোগ। কম্পিউটার ও চেয়ার-টেবিল ভাঙচুর করা হয়। ভাঙচুর করা হয় স্কুলের বাইরে থাকা একটি মোটরবাইকও। পুলিশকে সরিয়ে দিয়ে স্কুলের ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করেন অভিভাবকদের একাংশ।

আরও পড়ুন: স্কুলে শিশুনিগ্রহ, ভাঙচুর-বিক্ষোভে রণক্ষেত্র ঢাকুরিয়া

এ দিনের ঘটনায় ফের প্রশ্ন উঠেছে, শহরে একের পর এক স্কুলে বিভিন্ন ঘটনায় অভিভাবকেরা যে ভাবে আইন হাতে তুলে নিচ্ছেন, তার কি কোনও প্রয়োজন রয়েছে? এ বছরের শুরুর দিকেই কারমেল প্রাইমারি স্কুলে এক ছাত্রীকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছিল। তখন অভিযুক্তকে তাঁদের হাতে তুলে দেওয়ার দাবি জানাতে থাকেন অভিভাবকেরা। অভিযুক্তকে চাবকে পিটিয়ে মারার হুমকিও দেওয়া হয়। জি ডি বিড়লা সেন্টার ফর এডুকেশনে ছাত্রীকে যৌন নির্যাতনের ঘটনায় শিক্ষিকাকে জুতো দেখিয়েছিলেন অভিভাবকেরা। সম্প্রতি যাদবপুর বিদ্যাপীঠে ভর্তির বিজ্ঞপ্তির বক্তব্য ভুল বুঝে প্রধান শিক্ষকের উদ্দেশে কটূক্তি করা ছাড়াও রাস্তা অবরোধ করেছিলেন অভিভাবকেরা। এ বার সরাসরি শিক্ষিকাকে মারধরের ঘটনায় নিন্দায় সরব হয়েছে সমস্ত মহল। কলকাতা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের চেয়ারম্যান কার্তিক মান্না বলেন, ‘‘অভিভাবকদের সঙ্গে বহিরাগতেরাও ছিলেন। তাঁদের চিহ্নিত করে স্কুলের তরফে থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।’’

বেথুন কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা শাশ্বতী অধিকারী বলেন, ‘‘এটা ভাবতেই পারছি না। অভিভাবকদের যদি এই মূল্যবোধ হয়, তা হলে সন্তানেরা কী শিখবে?’’ স্কুলশিক্ষা দফতরের বিশেষজ্ঞ কমিটির চেয়ারম্যান অভীক মজুমদার বলেন, ‘‘ঘটনাটি অমানবিক ও নিন্দনীয়। সন্তানের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে বেদনা বা ক্ষোভ স্বাভাবিক। তা বলে সেটার বহিঃপ্রকাশ কদর্য বা রুচির বিরোধী যেন না হয়, সেটা খেয়াল রাখতে হবে।’’ হিন্দু স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক তথা রাষ্ট্রপতি পুরষ্কারপ্রাপ্ত তুষারকান্তি সামন্ত বলেন, ‘‘স্কুলকে আমরা ভাবতাম পুণ্যভূমি। সেখানে শিক্ষকের বিরুদ্ধে সন্তানতুল্য ছাত্রীকে যৌন হেনস্থার অভিযোগ ওঠা এবং তাকে কেন্দ্র করে শিক্ষিকাদের মারধরের ঘটনা খুব ব্যথিত করে। এর পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন।’’

দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের শিক্ষক অভিজিৎ কুন্ডুর বক্তব্য, ‘‘শুধু শিক্ষা ক্ষেত্রে নয়। সমাজের যে কোনও জনগোষ্ঠীর মধ্যেই অসম্ভব আক্রোশ তৈরি হচ্ছে। তারই প্রকাশ ওই স্কুলে দেখা গিয়েছে। এর মধ্যে লুকনো রয়েছে শ্রেণি-সংগ্রাম। এর বিনাশের রাস্তায় আমরা এখনও পৌঁছয়নি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Dhakuria School Teacher Assault Rude guardians
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE