ফিল্মের অঙ্গনে এক সময় পদবি ব্যবহারের রীতি ছিল না। সেই মতো, মায়ানগরীতে এসে গুরু দত্তও পারিবারিক নামটি ছোট করে নেন। একশো বছর আগে, যে ৯ জুলাই তাঁর জন্ম, দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার, তাই তাঁর নাম হয় গুরুদত্ত বসন্তকুমার শিবশঙ্কর পাড়ুকোন। সংস্কারজনিত কারণে গুরুদত্ত (ছবি) নামটিকেই প্রাধান্য দেয় পরিবার। কিন্তু কখন যে নামকে ভেঙে বাঙালিদের মতো ব্যবহার করতে শুরু করেন, জানা যায় না। শোনা যায়, উদয়শঙ্করের নাচের দলে বা পুণেতে নৃত্যশিক্ষক, সহকারী পরিচালকের কাজ করার সময় থেকেই ছবির নামলিপিতে নামকে বাঙালিদের মতো করে লেখা দেখে কিছু বলেননি। কারণ, আত্মায় যে বরাবরই বঙ্গতনয়। তাই, শুধু আজ নয়, তখন থেকেই মানুষ তাঁকে বাঙালি মনে করত।
এ শহরে তাঁর বড় হয়ে ওঠা, সাংস্কৃতিক চেতনারও ঋদ্ধি। কুড়ির দশকের শেষে তাঁর বাবা চাকরিসূত্রে বেঙ্গালুরু থেকে কলকাতা আসেন। কখনও ভবানীপুরে, কখনও পদ্মপুকুরের ফ্ল্যাটে থেকেছেন। অবাক হয়ে দেখতেন বাউল গায়কদের, সন্ধ্যারতির সময় দেওয়ালে আলোছায়ার খেলা। যাত্রার প্রতি ছিল টান। এখানেই আত্মীয় বি বি বেনেগালের আনা ফ্রি পাসে দিনে পারলে তিনটি করে সিনেমা দেখতেন ভাইবোনেরা, প্রধানত ধর্মতলা চত্বরে। ক্যামেরা চালাতে শেখাও এখানে, আর কিশোর গুরুদত্তের সেই অবিস্মরণীয় সাপ-নাচের সাক্ষীও ইডেন গার্ডেনস, যা দেখে দৃশ্য-শ্রাব্য মাধ্যমে ছেলেটির অসীম সম্ভাবনা সম্পর্কে নিঃশঙ্ক হন বেনেগাল। ছেলেটির শিল্পবোধে প্রসন্ন হয়ে উদয়শঙ্কর আলমোড়ায় নিজের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ডাক দেন।
হয়তো এক দশক থেকেছেন কলকাতায়। কিন্তু জীবনভর বাংলা থেকেই রসদ সংগ্রহ করেছেন, সেকালের বোম্বেতেও জ্ঞান মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শচীন দেব বর্মণের সঙ্গ করেছেন। এত সুন্দর বাংলা বলতেন যে মুম্বইয়ে প্রথম সাক্ষাতে গীতা দত্ত ও তাঁর বাবা যুবককে বাঙালিই ভেবেছিলেন। মুম্বইতে গীতা-গুরুর বিয়ে হয়েছিল বাঙালি মতেই। গুরু দত্তের মা বাংলায় লিখতেও পারতেন, গুরুর টান ছিল বাংলা সাহিত্যের রসাস্বাদনে। গুরু দত্তের ট্রিলজি-র মধ্যে পিয়াসা-র প্রেক্ষাপটে এই শহর, তার গঙ্গার ঘাট, পাড়ের বেঞ্চে বসা বেকার যুবক, হাওড়া ব্রিজ। চরিত্ররাও প্রধানত বাঙালি। আর বিমল মিত্রের কাহিনি অবলম্বনে সাহেব বিবি অউর গুলাম-কে যখন চিত্ররূপ দিলেন প্রযোজক গুরু দত্ত, তখন যেন এক মহাকাব্যের ধাত্রীভূমি হয়ে উঠল এ শহর। ক্ষয়িষ্ণু জমিদারপ্রথা, এক্কাগাড়ি, পায়রার ঝটপট, স্টিমারের ভোঁ, সবই তখন শহরের গয়না।
৯ জুলাই শতবর্ষ পূর্ণ করছেন গুরু দত্ত, সেই উপলক্ষে কলকাতা সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটি (কেসিসি) আগামী ১১ জুলাই আয়োজন করেছে নানা অনুষ্ঠান। কেসিসি-তে সকাল ১১টায় ইরা ভাস্করের সূচনা-ভাষণ ও প্রাসঙ্গিক আলোচনা, প্রশ্নোত্তর-পর্ব। দুপুর ১২টায় দেখানো হবে নাসরিন মুন্নি কবিরের প্রামাণ্যচিত্র ইন সার্চ অব গুরু দত্ত, শুরুতে অনলাইনে বলবেন নির্দেশক নিজে। সন্ধ্যা ৬টায় মধুজা মুখোপাধ্যায়ের আলোচনা, উঠে আসবে পিয়াসা, কাগজ় কে ফুল-সহ নানা ছবির দিক-আঙ্গিক। সন্ধ্যা ৭টায় দেখানো হবে পিয়াসা ছবির রেস্টোর্ড ভার্সন, এনএফডিসি-এনএফআই-এর সহযোগিতায়। এই সব নিয়েই শতবর্ষে গুরু দত্তকে স্মরণ করবে কলকাতা, ‘ইয়ে দুনিয়া অগর মিল ভি যায়ে তো’ শিরোনামে।
অঞ্জলি
কণ্ঠবাদনে বিশ্বাসী ছিলেন, কণ্ঠের অনুষঙ্গে শুধু তারযন্ত্র, বিশেষত এসরাজে পক্ষপাত ছিল ওঁর। বিজ্ঞানের কৃতী ছাত্র শৈলজারঞ্জন মজুমদার (ছবি) রবীন্দ্রনাথের গানের সুষ্ঠু সংরক্ষণে বৈজ্ঞানিক ভাবনারই প্রয়োগ করেন। তিনি শিক্ষক, স্বরলিপিকার; কালজয়ী নানা রবীন্দ্রসঙ্গীত রচনার প্রেক্ষাপটে তাঁর নামটি খোদিত। ওঁর জন্মের ১২৫ বছর উদ্যাপনে এগিয়ে এসেছেন অনেকে, নেতৃত্বে শৈলজারঞ্জনের সাক্ষাৎ শিষ্যেরা। ক’দিন আগেই ত্রিগুণা সেন মঞ্চে শিষ্যা এণাক্ষী চট্টোপাধ্যায় বললেন শৈলজারঞ্জনের শিক্ষণ-পদ্ধতি নিয়ে। ১০ জুলাই বিকেল সাড়ে ৫টায় রবীন্দ্রসদনে ‘কসবা সুরঞ্জনী’র অনুষ্ঠান ‘আমার আপন গান’, রীণা মুখোপাধ্যায়ের নির্দেশনায়। পিছিয়ে নেই এই প্রজন্মও। শৈলজারঞ্জনের গাওয়া ‘ওগো কাঙাল, আমারে কাঙাল করেছ’-র রেকর্ডিং শুনে তা অবিকল স্বরলিপিবদ্ধ করেছেন সাগরময় ভট্টাচার্য; এই গানটি এবং আরও কিছু অচলিত রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্বরলিপি প্রকাশ পাবে গ্রন্থাকারে, আচার্যের রবীন্দ্রভাবনাকেই যা ব্যাপ্তি দেবে।
প্রয়াণ
তাঁর হাত ধরেই শিক্ষাক্ষেত্রে পড়ুয়াদের মানসিক স্বাস্থ্যরক্ষার ভাবনা বাস্তবায়িত হয়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম কাউন্সেলিং সেল শুরু করেন তিনি। যাদবপুরে দর্শন বিভাগের প্রথম ছাত্র ছিলেন মাধবেন্দ্রনাথ মিত্র (১৯৩৭-২০২৫), কর্মজীবনও সেখানে। দর্শনের নানা বিষয়ে গবেষণা করেছেন, ছিলেন জাতীয় শিক্ষা পরিষৎ-এর সভাপতি। রচনা ও সম্পাদনা করেছেন স্টাডিজ় ইন লজিক, আ ডায়লগ বিটুইন দ্য ইস্ট অ্যান্ড দ্য ওয়েস্ট, রিয়েলিজ়ম: রেসপন্সেস অ্যান্ড রিঅ্যাকশনস, মনোদর্শন: শরীরবাদ ও তার বিকল্প প্রভৃতি বই। গবেষণা পত্রিকা দ্য ডন পুনঃপ্রকাশের নেতৃত্বে ছিলেন। পণ্ডিত, কর্মিষ্ঠ মানুষটি প্রয়াত হলেন সম্প্রতি।
নতুন ভাবনায়
“আর কোনো লেখার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথকে এতবার... সাজাতে হয়নি, রক্তকরবী-র বেলায় যেটা ঘটেছে।” লিখেছেন পল্লব সেনগুপ্ত। রক্তকরবী-র শতবর্ষে নতুন চোখে তাকে বুঝতে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশ পাচ্ছে বই, শতবর্ষে রক্তকরবী: নতুন ভাবনায় দেখা (প্রকা: প্রাচ্য পাশ্চাত্য), আজ বিকেল ৫টায় আশুতোষ মুখার্জি মেমোরিয়াল ইনস্টিটিউটে। থাকবেন অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য পবিত্র সরকার, চন্দন সেন মুনমুন গঙ্গোপাধ্যায় বিশ্বজিৎ রায় স্বাতী ভট্টাচার্য শুভময় মণ্ডল বলবেন এ নাটকের নানা দিক নিয়ে; সঙ্গে ‘গীতবিতান প্রাক্তনী’র গীতি-আলেখ্য ‘ঘুম ভাঙানিয়া গান’। ১০ জুলাই সন্ধে সাড়ে ৬টায় রোটারি সদনে প্রভা খৈতান ফাউন্ডেশন ও সাহিত্য অকাদেমির উদ্যোগে আর একটি অনুষ্ঠান, বলবেন শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়, রক্তকরবী-র গান শোনাবেন রাজশ্রী ভট্টাচার্য।
সময়োপযোগী
সাম্প্রতিক কালে ‘নন-ফিকশন’ নিয়ে বাঙালি লেখক ও পাঠকের আগ্রহ বেড়েছে। তবে বাংলায় তার রচনাশৈলী বা বিষয়ভাবনা নিয়ে জনপরিসরে আলোচনা, কিংবা এই উত্তর-সত্যের যুগে তার বস্তুনিষ্ঠতা রক্ষার সঙ্কট নিয়ে কথাবার্তা হয় না তত। এই ভাবনাই ভাবিয়েছে ‘কেতাব-ই’ প্রকাশনা কর্তৃপক্ষকে। মুদ্রিত বইয়ের পাশাপাশি ই-বুকের পরিসরেও তাঁদের কাজ কম নয়, তৈরি করেছেন অ্যাপ-নির্ভর ডিজিটাল লাইব্রেরিও। এ বার লেখক-পাঠক-প্রকাশক ত্র্যহস্পর্শে বাংলা নন-ফিকশন ধারা নিয়ে এক আলোচনার উদ্যোগ করেছেন ওঁরা। আজ সন্ধ্যা ৬টায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্দুমতী সভাগৃহে বলবেন পরিমল ভট্টাচার্য, সঙ্গে প্রতিক্ষণ, ব্ল্যাকলেটার্স, বোধশব্দ প্রকাশনার কর্ণধারেরা।
ছবির উৎসবে
সপ্তাহভর যদি দেশ-বিদেশের মোট ৯৮খানা ছোট ছবি আর তথ্যচিত্র দেখার সুযোগ মেলে, তার আনন্দই আলাদা। গত সাত বছর ধরে সে সুযোগই কলকাতাকে উপহার দিচ্ছে ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ় অব ইন্ডিয়া (এফএফএসআই)-এর পূর্বাঞ্চলীয় শাখা, ‘সাউথ এশিয়ান শর্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’ আয়োজন করে। অষ্টম বর্ষের উৎসব আগামী ৭-১৩ জুলাই দিনভর নন্দন ৩-এ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির ছবি তো প্রতিযোগিতা বিভাগে রয়েছেই, তার বাইরে ‘আন্তর্জাতিক জানালা’ ও ‘প্যানোরামা’ বিভাগে দেখা যাবে আমেরিকা কানাডা অস্ট্রেলিয়ার, এশিয়া ও ইউরোপের নানা দেশের ছবি। শর্ট ফিকশন ও তথ্যচিত্রের প্রতিযোগিতা বিভাগে সেরা তিনটি ছবি পাবে পুরস্কারও, যথাক্রমে ঋত্বিক ঘটক ও সত্যজিৎ রায়ের নামাঙ্কিত।
একদিন প্রতিদিন
“পুলিশের আইডেন্টিকাল পোশাক পরা কিছু মানুষের প্যান্টোমাইমের একটা দৃশ্য আছে কলকাতা ৭১-এ। বক্তব্য প্রকাশের তাগিদে বারে বারে অন্য আর্ট ফর্মের ব্যবহার করেছি,” বলতেন মৃণাল সেন, ক্ষয়িষ্ণু জীবনের দারিদ্র শোষণ মৃত্যুর ইতিহাসের সঙ্গে প্রতিরোধের চিহ্ন চেনাতেন আঙ্গিকের ভাঙচুরে। তাঁর সত্তর ও আশির দশকের ছবিতে যে বহুস্তরীয় উচ্চারণ, তারই প্রতিক্রিয়ায় দুই শিল্পী অমৃতা সেন ও মধুজা মুখোপাধ্যায়ের শিল্পকর্মের প্রদর্শনী শুরু হল গ্যাঞ্জেস আর্ট গ্যালারিতে: ‘স্পিচ অ্যাক্টস: রেসপন্সেস টু মৃণাল সেন’স সিনেম্যাটিক ওভর’। অমৃতার জলরংচিত্র (ছবি) ও অডিয়ো-ভিস্যুয়াল মাধ্যমে মধুজার শিল্পসংস্থাপন ফুটিয়ে তুলেছে এ শহরের রূপান্তর, মধ্যবিত্ত ও শ্রমজীবীর অভিব্যক্তি, রাগে উল্লাসে মুঠো-করা হাত, রাস্তাঘাট গলি ফুটপাত পাড়া, প্রতিদিনের বাস্তব। গুণিজন-উপস্থিতিতে শুরু হল গত ২ জুলাই, চলবে ২ অগস্ট পর্যন্ত, প্রতিদিন ১১-৭টা, রবিবার বাদে।
চিরায়ত
বাংলা ও ভারতের গণ্ডি ছাপিয়ে বিশ্বমঞ্চে গৌরবের ঠাঁই করে নিয়েছে পুরুলিয়ার ছৌ। ঝাড়খণ্ডের সেরাইকেলা ছৌ-ও (ছবি) কম কিসে! লোকনাট্য, মার্শাল আর্ট আর ধ্রুপদী সূক্ষ্মতার উৎকর্ষে, সুদৃশ্য মুখোশ ও নৃত্যভঙ্গির ব্যবহারে, পুরাণ-মিথ ও লোকবিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশে গড়ে উঠেছে তার সুদীর্ঘ ঐতিহ্য। এই নৃত্যশৈলীর অন্যতম শিক্ষক ও পুরোধা গুরু মলয় কুমার সাহু, শ্রী কেদার আর্ট সেন্টার-এর পরিচালক এই মুহূর্তে কলকাতায়, গতকাল কলকাতা সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটি (কেসিসি)-তে লেকচার-ডেমনস্ট্রেশনে বোঝালেন সেরাইকেলা ছৌয়ের ইতিহাস ও দর্শন। আজও বিকেল সাড়ে ৫টা থেকে ৭টায় কেসিসি-তে এই লোকনৃত্য-আঙ্গিকে তাঁর ও তাঁর দলের পরিবেশনা দেখার সুযোগ। চিরায়ত লোককাহিনি এবং সমসময়ের ভাবনা, ফুটে উঠবে দুই-ই।
উল্টো
সেই কবে বসন্তক পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, “গবর্ণমেন্ট প্রজার মা-বাপ, যদি সুখে না থাকে, তবে গবর্ণমেন্টের দোষ কি? তাহাদেরই দোষ।” সোজা কথা উল্টে বলার মধ্যে লুকিয়ে থাকা বার্তা দৈনন্দিন কথোপকথনে আনে মিঠেকড়া স্বাদ। সাহিত্য থেকে হাল আমলের ‘মিম’-এও ঘুরিয়ে বা উল্টো করে বলার উদাহরণ ছড়াছড়ি। যোগীন্দ্রনাথ সরকার তো বলেছেনই, মজার দেশে ‘চোখ খুললে যায় না দেখা মুদলে পরিষ্কার’। পরশুরামের ‘উলট পুরাণ’-এ ইংরেজদের বোঝানো হয়েছিল, ভারতের সহানুভূতি বিনা তাদের গতি নেই। বারমুখো সাধারণ মানুষের ঘরে ফেরাও তো ‘উল্টো পথে’ ফেরা। দেবতাই বা বাদ যায় কেন, তাদের ক্ষেত্রেও মানুষ সেই যুক্তিই চাপিয়েছে: যেখান থেকে শুরু, সেখানেই ফেরা। শাস্ত্রে পুনর্যাত্রা, লোকমুখে আজ উল্টোরথ। এই শহর আর রাজ্যের যা উল্টো চক্কর দেখা যাচ্ছে, এ কি সোজা পথে ফিরবে?
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)