হাতিবাগান
এই সেই ‘অপারেশন সানশাইন’-এর হাতিবাগানের ফুটপাথ। ১৯৯৬ সালের রাতে অতর্কিতে বুলডোজার চালিয়ে হকার উচ্ছেদের পরে যে ফুটপাথে হাতিবাগান মোড়ে দাঁড়িয়েই সোজা দেখতে পাওয়া গিয়েছিল শ্যামবাজারের নেতাজি মূর্তি।
২০১৬ সালে সেই ফুটপাথেই বেদখল করে বসা হকারদের গুনে শেষ করা কার্যত অসম্ভব। এবং তাঁদের কেউ উচ্ছেদ করবে, সে কথা ভাবতেও পারেন না। কারও দোকান ২৬ বছরের, কেউ ১৭ বছর ধরে ব্যবসা জমিয়ে তুলেছেন, কেউ বা দোকান খুলেছেন বছর পাঁচেক আগে। যাঁদের সৌজন্যে বিধান সরণি, ভূপেন বসু অ্যাভিনিউ, বাগবাজার— উত্তর কলকাতার বিস্তীর্ণ ফুটপাথ হকারের দখলে। হাতিবাগানে ফুটপাথ ছেড়ে রাস্তায় নামতেই অভ্যস্ত পথচারীরা।
বিধান সরণির ফুটপাথ জুড়ে প্রায় তিনশোর বেশি দোকান। ভূপেন বসু অ্যাভিনিউয়ে প্রায় শ’খানেক। তুলনায় একটু পিছিয়ে বাগবাজার স্ট্রিট। সেখানকার ফুটপাথে প্রায় পঞ্চাশটি দোকান রয়েছে। ব্যবসায়ীরা কেউ নিজেই মালিক, কেউ বা মহাজনের থেকে টাকা নিয়ে অংশীদারি কারবার চালাচ্ছেন। এলাকা ঘুরে, দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল— পুলিশের লিখিত অনুমতি নেই প্রায় কারও কাছেই। তবে দোকানিরা জানালেন, কোনও পুলিশি ঝঞ্ঝাট তাঁদের সহ্য করতে হয় না। পাশে আছে হকার্স ইউনিয়নের ‘দাদা’রা।
দীর্ঘ সতেরো বছর ধরে কেউ প্রতিদিন নদিয়ার রানাঘাট থেকে কলকাতায় এসে ফুলের ব্যবসা করছেন। কেউ আবার উত্তর ২৪ পরগনার হাবড়া থেকে শ্যামবাজারে আসেন রোজ। গত ২৬ বছর ধরে এ ভাবেই ফল বেচছেন ভূপেন বসু অ্যাভিনিউয়ে। কেউ বা কাছাকাছি ঘর ভাড়া নিয়ে কচুরি-আলুরদমের দোকান চালাচ্ছেন। পুরনো দোকানিদের কারও কারও কথায়, আগে বেআইনি ভাবে বসা নিয়ে ঝামেলা পোয়াতে হলেও ইদানীং সে সব হয় না বললেই চলে।
ভূপেন বসু অ্যাভিনিউ
শ্যামবাজার মেট্রো স্টেশনের ৪ নম্বর গেটের কাছে কচুরি-ঘুগনির ছোট্ট দোকানি জানালেন, বছর পাঁচেক আগে হাতিবাগানে দোকান ছিল তাঁর। ইউনিয়নের গোলমালের জেরে সে দোকান উঠে গিয়েছিল। এ বার তিনি দোকান সাজিয়েছেন ভূপেন বসু অ্যাভিনিউয়ে। প্রথম কয়েক দিন থানার কর্তারা বাধা দিয়েছিলেন। পরে ‘দাদাদের’ সৌজন্যেই আর সমস্যা হয়নি। হাতিবাগানের এক চাটের দোকানিও জানালেন, ২০১৭-য় তেইশ বছরে পা দেবে তাঁর দোকান। তাঁর দাবি, যে দল সরকারে ক্ষমতায় থাকে, তাদের ইউনিয়নের মতে চলতে পারলেই আর কোনও ঝামেলায় পড়তে হয় না। পুলিশকে হপ্তা দেওয়ার অভিযোগ তাঁদের নেই। তবে ইউনিয়নে চাঁদা দিতে হয় সপ্তাহে বার দুয়েক। চাঁদার অঙ্ক কখনও পাঁচশো, কখনও বা দেড় হাজার।
ফুটপাথ আটকে ‘অবৈধ’ এ সব দোকান সরকার যে কোনও দিন তুলে দিতে পারে— কথা শুনে হেসে গড়িয়ে পড়লেন ভূপেন বসু অ্যাভিনিউয়ের একটি সরবতের দোকানি। বললেন, ‘‘এত বছর ধরে ব্যবসা করছি। তুলে দেবে বললেই হল? ও সব হবে না।’’ যদি কখনও হয়, তা হলে কী করবেন? তাঁর উত্তর, ‘‘এখান থেকে যদি সরে যেতেও হয়, আমরা জানি পুলিশ ঠিক আবার অন্য জায়গা দেবে। তা না হলে ইউনিয়ন ছেড়ে কথা বলবে না।’’
কী বলছে হকার্স ইউনিয়ন?
ফুটপাথ জোড়া দোকানগুলির অনুমতি না থাকা সত্ত্বেও ইউনিয়নের অবশ্য সোজাসাপ্টা দাবি, হাতিবাগানের ফুটপাথে বসা হকারেরা কেউই অবৈধ ভাবে ব্যবসা করছেন না। সেই সঙ্গেই সংগঠনের এক কর্তাব্যক্তি বলেন, ‘‘ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার জন্য কাউকেই আমরা জোরজুলুম করি না। চাঁদা নিই। তবে যার যেমন খুশি, দেন।’’
বিধান সরণির বিস্তীর্ণ এলাকা কলকাতা পুরসভার ১১ নম্বর ওয়ার্ডে। কাউন্সিলর তথা পুরসভার স্বাস্থ্য দফতরের মেয়র পারিষদ অতীন ঘোষ জানান— কোন দোকানি, কোন ক্লাবকে টাকা দেন, তা তাঁর জানা নেই। তবে ফুটপাথ আটকে দোকানের জেরে পথচারীদের সমস্যার কথা মেনে নিচ্ছেন তিনি। অতীনবাবুর কথায়, ‘‘কলকাতায় দিন দিন হকারের সংখ্যা বাড়ছে। মানছি, এতে সাধারণ মানুষের অসুবিধাও হচ্ছে। কিন্তু পুরসভার পক্ষে একক ভাবে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। রাজ্য সরকারকে সুনির্দিষ্ট নীতি তৈরি করতে হবে। যাতে ফুটপাথ দখল করা দোকানের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।’’
ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy