Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪

আইন ভাঙা হেঁশেলেই ব্রিগেডের ভোজ-সভা

দৃশ্য-১। ইস্টবেঙ্গল মাঠের অদূরেই দাউ-দাউ করে জ্বলছে গ্যাসের আভেন। তাতে ঢাউস হাঁড়িতে মাংস কষানো হচ্ছে। রবিবার দুপুরে মন দিয়ে রান্নার তদারকির ফাঁকে সিউড়ির রানা দত্ত বোঝালেন, ‘‘সেই কাকভোরে দল বেঁধে বাসে বেরিয়েছি! অতটা রাস্তা ঝাঁকুনিতে রান্না-করা খাবার নিয়ে আসা কী মুখের কথা! তাই এখানেই গুছিয়ে রাঁধতে লেগেছি!’’

এ ভাবেই অবাধে উনুন জ্বেলে রান্না।

এ ভাবেই অবাধে উনুন জ্বেলে রান্না।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০১৫ ০১:৩৭
Share: Save:

দৃশ্য-১। ইস্টবেঙ্গল মাঠের অদূরেই দাউ-দাউ করে জ্বলছে গ্যাসের আভেন। তাতে ঢাউস হাঁড়িতে মাংস কষানো হচ্ছে। রবিবার দুপুরে মন দিয়ে রান্নার তদারকির ফাঁকে সিউড়ির রানা দত্ত বোঝালেন, ‘‘সেই কাকভোরে দল বেঁধে বাসে বেরিয়েছি! অতটা রাস্তা ঝাঁকুনিতে রান্না-করা খাবার নিয়ে আসা কী মুখের কথা! তাই এখানেই গুছিয়ে রাঁধতে লেগেছি!’’

শুধু ওখানেই নয়। রান্নার ঢালাও আয়োজন শহিদ মিনারের উল্টো দিকের মাঠ, পার্ক স্ট্রিট-মেয়ো রোডের দিকের মাঠেও। আদালতের পরিবেশ-বিধি অনুযায়ী, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের তিন কিলোমিটারের মধ্যে রান্নাবান্না নিষেধ। ব্রিগেডের এই সমাবেশের উদ্যোক্তা সিপিএমের তরফেও দলীয় মুখপত্রে বলা হয়েছিল, ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ড লাগোয়া এলাকা বা পার্কিং লট— কোথাও আগুন জ্বেলে রান্না চলবে না। বাস্তবে দেখা গেল, মাঠের ক্ষতি করে উনুন খোঁড়াখুঁড়ি তেমন না হলেও, গ্যাস-স্টোভের সম্ভারের অভাব নেই। অর্থাৎ, রাজ্যের তিন দশকের শাসক থেকে অধুনা বিরোধী দল সিপিএমে এখনও নেতাদের নির্দেশ, দলের নিচুতলায় ঠিকঠাক কানে ঢুকছে বলে এ দিন অন্তত ব্রিগেডে প্রমাণ মিলল না।

দৃশ্য-২। ময়দানে ছুটির মজা মাঠে মারা যাবে, তা তো জানাই ছিল! দেখা গেল, মাঠটুকুও রেহাই পায়নি মোটে। মাঠের উপরে পরপর বাস উঠতে শুরু করেছিল সকাল দশটা থেকেই। রাজস্থান ক্লাবের পিছনের মাঠে পিচ বাঁচাতে ত্রিপল নিয়ে হাঁ-হাঁ করে ছুটে উঠে এলেন কয়েক জন মাঠকর্মী। এক কোণে চিলতে ঘেরাটোপে নেট প্র্যাকটিস চলছে। শ্যাডো করার ফাঁকে তরুণ ক্রিকেটার নিজের মনেই বলে উঠলেন, ‘‘বাসের পর বাস উঠে আউটফিল্ডটা যা ক্ষত-বিক্ষত হল, তাতে বেশ কয়েক দিনই খেলার বারোটা বাজবে মনে হচ্ছে।’’

দৃশ্য ৩। খিদিরপুর রোড দিয়ে মাঠে ঢুকে সমাবেশস্থলের দিকে এগোতে এগোতে ধুলোর ঝড়ের মুখোমুখি। নাকে-মুখে কাপড় চেপে চোখটুকু বার করে সভাস্থলে এগোচ্ছে মানুষের জটলা। ঘাসহীন ন্যাড়া অংশটা দিয়ে ধুলো ঠেলে এগোনোই দুষ্কর। জনৈক স্বেচ্ছাসেবককে প্রশ্ন করা হল, মাঠের ন্যাড়া অংশে কি সকালে জল দেওয়া হয়েছিল? সদুত্তর মিলল না তাঁর কাছে।

দৃশ্য-৪। খাওয়াদাওয়া তো হল, কিন্তু প্রকৃতির ডাক উপেক্ষা করার সাধ্যি কার! তাই যে-যেখানে একটু আড়াল পেয়েছেন, দাঁড়িয়ে পড়েছেন। লাখো লোকের ভিড়। কিন্তু অস্থায়ী শৌচাগারের সংখ্যা হাতে গোনা। মানুষের বর্জ্যের উৎকট গন্ধে নাকে রুমাল চেপে রেখেও শান্তি নেই। ডাস্টবিনও কদাচ চোখে পড়েছে মাঠময় ঘুরতে ঘুরতে। মাঠের মাঝখান থেকে শুরু করে কোণার ঝোপঝাড়— সবই যেন অঘোষিত ‘ধাপার মাঠ’। থার্মোকল-কাগজের প্লেট, ভাত-ডাল-মাংসের ভুক্তাবশেষ, কমলালেবুর খোসা থেকে বিস্তর খবরের কাগজের পাতা— সর্বত্র থইথই করছে। বিকেল পাঁচটার পরে অবশ্য সংগঠকদের তরফে স্বেচ্ছাসেবকেরা সক্রিয় হয়েছেন। কিন্তু সন্ধ্যা পর্যন্ত দিনভর মাঠময় তাণ্ডবের চিহ্ন মুছে ফেলা সম্ভব হয়নি।

পাত পেড়ে খাওয়াদাওয়া। রবিবার।

২০০৭-এর কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের রায় অনুসারে, ভিক্টোরিয়ার তিন কিলোমিটারের মধ্যে উনুন জ্বালানো যাবে না। পার্ক করা যাবে না গাড়ি। নিয়ম ঠিকমতো পালন করা হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য পুলিশকে ভিডিও ক্যামেরার সাহায্যে পুরো বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। রাজনৈতিক দলগুলিকেও সমাবেশের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ময়দান পরিষ্কার করে দিতে হবে। পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্তের আক্ষেপ, ‘‘দিনের পর দিন এই নির্দেশের তোয়াক্কা না করেই রাজনৈতিক দলগুলি সভা, সমাবেশ করছে।’’ সিপিএমের এক রাজ্য নেতার দাবি, যদি কেউ নিয়ম ভেঙে মাঠে রান্না করে থাকেন, তবে অন্যায় করেছেন। খোঁজ নিয়ে দেখব।’’ কাল, সোমবারের মধ্যে ময়দানের আবর্জনা যত দূর সম্ভব পরিষ্কার করে দেওয়া হবে বলেও আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।

কিন্তু ময়দান বাঁচাতে কি একটুও নজর দিতে পারত না রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ? পর্ষদের চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্রর জবাব, ‘‘ময়দান সংরক্ষণে হাইকোর্টের নির্দিষ্ট নির্দেশ ছিল। এ তো রাজনৈতিক সদিচ্ছার ব্যাপার, সেই নির্দেশ মানা হবে কি না। হাইকোর্টের নির্দেশ মানা হচ্ছে কি না, তা দেখা পর্ষদের এক্তিয়ারে নেই।’’ সুভাষবাবু অবশ্য জানান, প্রয়োজনে বিষয়টি পরিবেশ আদালতে জানাবেন।

ছবি দু’টি তুলেছেন রণজিৎ নন্দী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Brigade high court violated CPIM
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE