Advertisement
০৭ মে ২০২৪

ফার্স্ট বয়ের নাম পৌঁছয় ইংল্যান্ডে রানির কাছেও

এক জন মালিক পছন্দমত ঘোড়াটি কিনে তার অভিভাবকত্ব পান। তিন বছর বয়স থেকে প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় কোনও ঘোড়া। আয়ু বড়জোর ২৪।

রাজকীয়: রেস শুরুর আগে দর্শকদের সামনে ঘোড়ার প্রদর্শন। ছবি: সুমন বল্লভ

রাজকীয়: রেস শুরুর আগে দর্শকদের সামনে ঘোড়ার প্রদর্শন। ছবি: সুমন বল্লভ

জয়তী রাহা
শেষ আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০১:৪৩
Share: Save:

ওদের জন্য আজও প্রতি বছর চিঠি আসে রানির দরবার থেকে। তখনই লন্ডনে তৈরি হতে শুরু করে রত্নখচিত ১০০ গিনির মূল্যের রাজকীয় কাপটি| প্রতি বছর একই রূপে ধরা দেয় সে। দীর্ঘ পরিশ্রমের শেষে স্কুলের চূড়ান্ত পরীক্ষায় সন্তানের সেরা হওয়ার মতোই আনন্দ এনে দেয় বিজয়ী, বলছিলেন এক অভিভাবক।

অভিভাবকই বটে| সন্তানসমকে গুরুগৃহে পাঠিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ায় বিশ্বাসী তাঁরা। থাকা-খাওয়া-কসরত সবই চলে সেখানে। ওদের পছন্দ বুঝে ওটস, মিলেট, যব, বার্লির মতো খাবার দেওয়া হয়। পুরনো ধারণায় ডায়াটিশিয়ানরা অবশ্য পালংশাক, গাজর, পেঁপে খাওয়ানোয় বিশ্বাসী। তবে ওদের মূল খাবার ঘাস। সঙ্গে প্রশিক্ষকের নজরদারিতে চলে দৌড়বীর ঘোড়াদের প্রশিক্ষণ। এক জন অ্যাথলিটের মতোই চলে দৌড়, সাঁতার, লাফানোর ব্যায়াম। সবটাই হয় রয়্যাল ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাবের নিজস্ব আস্তাবলে। প্রশিক্ষণ শুরু হয় দু’বছর বয়সেই।

তার আগে পর্যন্ত মায়ের সঙ্গে ঘোড়ার খামারে থাকে ওরা। রেসের জন্য থরোব্রেড প্রজাতির ঘোড়ার জন্ম ও প্রতিপালন করা হয় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মুম্বই, পঞ্জাব, হরিয়ানার খামারে। দাম ধার্য হয় পারিবারিক ইতিহাস অথবা রেসের ফলাফলের ভিত্তিতে। ৫০ হাজার থেকে ৫০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত হতে পারে ওদের দাম।

এক জন মালিক পছন্দমত ঘোড়াটি কিনে তার অভিভাবকত্ব পান। তিন বছর বয়স থেকে প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় কোনও ঘোড়া। আয়ু বড়জোর ২৪। সাত বছর বয়সের মধ্যেই ফুরিয়ে যায় ওদের দৌড়ের ক্ষমতা। অবশ্য এর ব্যতিক্রমও আছে। বয়স মাপার এক অদ্ভুত নিয়ম আছে ওদের। জানুয়ারি থেকে জুনে জন্মানো সব ঘোড়াকেই পরের পয়লা জানুয়ারিতে এক বছরের বলা হয়। প্রতিযোগিতায় স্বচ্ছতা আনতে বিশেষ ব্যবস্থাও রয়েছে। এ জন্য তাদের উপরে হ্যান্ডিক্যাপ চাপানো হয়। ঘোড়ার ক্ষমতা পরীক্ষা করে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে কাজটি করেন এক জন হ্যান্ডিক্যাপার। জকির ওজনের সঙ্গে প্রয়োজন মতো ঘোড়ার সাজ মিলিয়ে ভার চাপানো হয় ঘোড়ার পিঠে। কখনও সিসার পাতও যুক্ত হয়। সব মিলে এই ওজন হয় ৫০-৬২ কেজির মধ্যে, বলছিলেন আরসিটিসি-র নবীন প্রশিক্ষক রৌনক বন্দ্যোপাধ্যায়। সেন্ট জেভিয়ার্সের এই প্রাক্তনী ঘোড়ার টানে অর্থনীতি ছেড়ে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমান প্রশিক্ষণ নিতে। এই মুহূর্তে তাঁর প্রশিক্ষণে রয়েছে তিরিশটি ঘোড়া।

আরসিটিসি-র সেক্রেটারি কাঞ্চন জানা জানান, আস্তাবলে ৪৬০টি ঘোড়া রয়েছে। প্রত্যেকের জন্য এক জন সহিস থাকে। এ ছাড়া জকি, প্রশিক্ষক, ডায়াটিশিয়ান, হাসপাতাল-ডাক্তার এবং আরসিটিসি-র ছাতার নীচে আরও অসংখ্য কর্মী রয়েছেন। আক্ষরিক অর্থে এ এক রাজসূয় যজ্ঞ|

এখনও এ দেশে ঘোড়দৌড়কে শুধু জুয়া ভাবা হয়, এটাই বড় সমস্যা। বলছিলেন ন’টি ঘোড়ার অভিভাবক এবং পেশায় ব্যবসায়ী গৌতম সেনগুপ্ত। তাঁর মতে, জুয়া তো হয় ক্রিকেট, ফুটবলেও। তাহলে ঘোড়দৌড় কেন খেলার মর্যাদা পাবে না? অথচ সরকারি তহবিলে মোটা টাকা যায় এখান থেকেও। এক সময়ে চল্লিশটি ঘোড়া ছিল তাঁর। ষোলো বছর বয়সে জ্যাঠামশাইয়ের হাত ধরে মাঠে আসেন। পেরিয়েছে পঞ্চাশ বছর। টানটা কিন্তু আজও একই রকম।

বহাল ঐতিহ্যও। ১৮৪৭ সালে শুরু আরসিটিসি-র পথচলা। তারও আগে এ শহরে ঘোড়দৌড়ের প্রমাণ মেলে। নবাবি শখে নেহাতই বিক্ষিপ্ত ভাবে গার্ডেনরিচের আক্রায় ছিল সে সব। শহরে ঘোড়দৌড়ের বড় আসরের মধ্যে রয়েছে বছরের প্রথম দিন, দু’টি ডার্বি এবং একটি কুইন্‌স কাপ। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ সিংহাসনে বসেন ১৯৫২ সালে। তার পরের বছর থেকে শুরু এই কুইন্‌স কাপ| ধারা বজায় রাখতে বাকিংহাম প্যালেসের সিলমোহর লাগানো চিঠিটা আসতেই শুরু হয়ে গিয়েছিল চূড়ান্ত প্রস্তুতি|

শনিবার ছিল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। বালি আর চামড়ার গুঁড়োর ট্র্যাকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল ওরা। স্টার্টার দরজা খুলতেই দৌড় শুরু। তিন মিনিট তিন সেকেন্ডে ২৮০০ মিটার পেরিয়ে ২০১৮ সালের বিজয়ী হল উইন্টার রেনেসাঁ। রানির প্রতিনিধি, দিল্লি থেকে আসা ব্রিটিশ হাই কমিশনার ডমিনিক অ্যাসকুইথ সেই ট্রফি তুলে দিলেন বিজয়ীর অভিভাবকের হাতে।

রাজকীয় সেই জয়ের খবর প্রথা মাফিক পৌঁছে গেছে রানির কাছেও!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE