Advertisement
E-Paper

বাকিটাও যদি ভেঙে পড়ে !

পাক্কা আড়াই ঘণ্টা কেটে গিয়েছে তখন। দুর্ঘটনাস্থল থেকে প্রায় পাঁচশো মিটার দূরে বসে ‘আতঙ্কে’ কাঁপছিলেন পানবিক্রেতা সুরজ সোনকার। ভয়ে কাঁপছিলেন, ‘‘আমার দোকানের উপরেও তো উড়ালপুলের বাকি অংশ রয়েছে। এটাও আবার ভেঙে পড়বে না তো!’

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০১৬ ০২:৩৯
ভয়ার্ত চোখ। দুর্ঘটনাস্থল ও আশপাশের বাড়িতে, বৃহস্পতিবার। — দেশকল্যাণ চৌধুরী

ভয়ার্ত চোখ। দুর্ঘটনাস্থল ও আশপাশের বাড়িতে, বৃহস্পতিবার। — দেশকল্যাণ চৌধুরী

পাক্কা আড়াই ঘণ্টা কেটে গিয়েছে তখন। দুর্ঘটনাস্থল থেকে প্রায় পাঁচশো মিটার দূরে বসে ‘আতঙ্কে’ কাঁপছিলেন পানবিক্রেতা সুরজ সোনকার। ভয়ে কাঁপছিলেন, ‘‘আমার দোকানের উপরেও তো উড়ালপুলের বাকি অংশ রয়েছে। এটাও আবার ভেঙে পড়বে না তো!’

শুধু ওই দোকানদারই নন। বৃহস্পতিবার গণেশ টকিজ মোড়ে বিবেকানন্দ উড়ালপুলের ১০০ মিটার অংশ ভেঙে পড়ার পর থেকে একই রকম আতঙ্কে ভুগছেন আশপাশের বাসিন্দা থেকে দোকানদার, পথচারীরা। যত বারই ক্রেন দিয়ে কংক্রিট ও লোহার অংশ টেনে তোলার চেষ্টা চলেছে, তত বারই ভয়ে ইষ্টনাম জপছিলেন তাঁরা। কারণ, ক্রেনের ধাক্কায় মাঝেমধ্যেই কেঁপে উঠছিল উড়ালপুলের স্তম্ভ, পাশের বহুতলগুলি।

এ দিন বেলা সাড়ে ১২টা নাগাদ ঘটনার পর থেকে বেলা যত গড়িয়েছে, ততই বেড়েছে সাধারণ মানুষের আতঙ্ক। এমনকী, নিজের বাড়িতে বসেও স্থির থাকতে পারছিলেন না কেউই। গণেশ টকিজ মোড়ে ২ নম্বর কালী কৃষ্ণ টেগোর রোডের পুরনো বহুতলের ঘরে বসে পুরণমল ধানুকা যেমন বারবারই ভগবানকে ধন্যবাদ দিচ্ছিলেন। বললেন, ‘‘ডালপট্টি থেকে ডাল কিনে মাত্র পাঁচ মিনিট আগে ওই উড়ালপুলের নীচ দিয়েই হেঁটে বাড়ি ঢুকেছি। একটুর জন্য বেঁচে গেলাম।’’ তিনি জানান, বাড়ি ফেরার পরেই বিকট শব্দ শুনে ভেবেছিলেন, বোধ হয় ট্রাম-দুর্ঘটনা ঘটেছে। বারান্দায় বেরিয়ে আসতেই চক্ষুস্থির। ভয়ার্ত চোখে পুরণমল ও তাঁর স্ত্রী লক্ষ্মীদেবী দেখেন, বাড়ির পাশে আস্ত উড়ালপুলটাই ভেঙে পড়েছে। চারদিক ধোঁয়ায় ঢাকা। একই রকম অভিজ্ঞতা হয়েছে ওই বহুতলেরই বাসিন্দা দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র মৃদুল খেমকার। ঘটনার পরেই ভয়ের চোটে মাকে নিয়ে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসেন তিনি।

দুপুরবেলাই ফোনটা আসে গোপাল পেরিয়ানের কাছে। ও পারে কাঁদছেন স্ত্রী। অফিসে জরুরি কাজ ফেলে দুর্ঘটনাস্থলের কাছেই নিজের বাড়িতে ফিরে যান তিনি। গোপাল বলেন, ‘‘ইয়ার এন্ডিংয়ের কাজ চলছিল। কিন্তু ফোন পেয়েই অফিসে জানিয়ে দিই— আগে পরিবার, তার পরে কাজ।’’ এর পরেই দুপুর ২টো নাগাদ পুলিস এসে তাঁর বাড়ি-সহ আরও কয়েকটি বহুতল খালি করে দেওয়ার নির্দেশ দেয়।

ঘটনার অনেকক্ষণ পরেও ধ্বংসস্তূপের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন কয়েক জন প্রত্যক্ষদর্শী। চোখেমুখে তখনও আতঙ্ক। তাঁদেরই এক জন, গৌরব খাস্তগীর বলেন, ‘‘রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে মোবাইল দেখছিলাম। আচমকা বিকট শব্দ আর ধোঁয়া। ভয়ে দৌড়তে শুরু করলাম। কিছুটা গিয়ে পিছন ফিরে দেখি উড়ালপুল ভেঙে পড়েছে।’’ উড়ালপুলটির অদূরেই একটি স্কুল। তার প্রধান শিক্ষক সি ভি দ্বিবেদী বলেন, ‘‘আওয়াজ শুনে পড়ুয়ারা ভয়ে চিৎকার শুরু করে দিয়েছিল। কোনও মতে ওদের সামলে স্কুলের দরজা বন্ধ করে দিই। তার মধ্যেই লোডশেডিং। মোবাইলের নেটওয়ার্কও থাকছিল না। কোনও মতে সমস্ত অভিভাবকদের খবর পাঠাই।’’

এ দিন ঘটনার পরেই তিন-চারটি ক্রেন নিয়ে কংক্রিটের চাঙড় সরানো শুরু হয়। তাতেই ভয় বাড়তে থাকে আশপাশের বাসিন্দাদের। কারণ পুরনো বাড়িগুলোতে লোহার কাঠামোর ধাক্কা লাগলেই কেঁপে উঠছিল। শুধু তা-ই নয়। মাঝে মধ্যেই কেঁপে উঠছিল উড়ালপুলের অবশিষ্ট অংশও। তার জন্য রাস্তায় ভিড় করে থাকা জনতাকেও লাঠি উঁচিয়ে হটিয়ে দিচ্ছিলেন পুলিশকর্মী, স্থানীয় যুবকেরা। তবে শেষমেশ ভিড় সামলাতে দড়ি দিয়ে ব্যারিকেড করা হয়। ভিতরে দাঁড়ানো কয়েক জন পথচারী মন্তব্য করেন, ‘‘শেষ দু’মাস উড়ালপুলের উপর থেকে মাঝেমধ্যেই কংক্রিটের ছোটখাটো চাঙড় খসে পড়ছিল। তার পরেও তো কেউ কিছু করেনি!’’

ঘটনার পরে উড়ালপুল-মুখী বিভিন্ন বহুতল ও ছাদে ভিড় করেন এলাকার মানুষ। এক চিলতে জানলায় একগুচ্ছ মুখ। হ্যান্ড মাইকে পুলিশ ও বিপর্যয় মোকাবিলা দফতর বলছিল, ‘‘বাকি অংশ এখনও বিপজ্জনক। আপনারা সরে যান,’’ প্রতি বারই তৎক্ষণাৎ ভয়ে ভিতরে ঢুকে যায় উৎসুক মুখগুলি।

রাত পর্যন্ত এলাকার অনেকেই বাড়ি ছেড়ে আত্মীয়ের বাড়িতে চলে গিয়েছেন। স্ত্রী-ছেলেমেয়েকে নিয়ে আত্মীয়ের বাড়িতে যাওয়ার পথে সঞ্জীব বনশল বলে যান, ‘‘বেঘোরে মরতে পারব না। প্রাণে তো বাঁচতে হবে!’’

tragedy kolkata flyover collapse
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy