Advertisement
০২ মে ২০২৪
বারুইপুর

বোঝাই অটোয় ন’জন, চালক বসেন সিটে ঠেকে

এক ঝলকে যেন পুরুলিয়া বা বাঁকুড়ার কোনও বাজার অঞ্চল। যেখানে একের পর এক ট্রেকারের পেটে পিলপিল করে ঢুকে পড়ে মানুষ, ছাগল, মুরগি, ঝু়ড়ি, ঝাঁটা। আসন ভর্তি হয়ে গেলে ছাদও বোঝাই। তাই নিয়ে কালো ধোঁয়া ছেড়ে, শব্দ করে ছোটে ট্রেকার।

ঝুঁকির যাতায়াত। শশাঙ্ক মণ্ডলের তোলা ছবি।

ঝুঁকির যাতায়াত। শশাঙ্ক মণ্ডলের তোলা ছবি।

তিয়াষ মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০১:৫৫
Share: Save:

এক ঝলকে যেন পুরুলিয়া বা বাঁকুড়ার কোনও বাজার অঞ্চল। যেখানে একের পর এক ট্রেকারের পেটে পিলপিল করে ঢুকে পড়ে মানুষ, ছাগল, মুরগি, ঝু়ড়ি, ঝাঁটা। আসন ভর্তি হয়ে গেলে ছাদও বোঝাই। তাই নিয়ে কালো ধোঁয়া ছেড়ে, শব্দ করে ছোটে ট্রেকার।

খাস শহরতলির বুকেই মিলে যায় প্রায় কাছাকাছি দৃশ্যপট। তবে ট্রেকার নয়, অটো। সৌজন্যে বেপরোয়া চালককুলের আইন ভাঙার অভ্যাস। বারুইপুর স্টেশনের বাইরে থেকে মুহূর্মুহূ অটো ছাড়ছে গড়িয়া, রাজপুর, চম্পাহাটি, জুলপিয়া, ক্যানিং রুটের। প্রতিটি অটোর দু’পাশ থেকে বেরিয়ে রয়েছে যাত্রীদের পা, ব্যাগ, শাড়ির আঁচল। গুণে দেখা গেল, পিছনের আসনে চার জন ঠাসাঠাসি। সামনে চালকের দু’পাশেই দু’জন করে বসেছেন। মহিলাও আছেন তাঁদের মধ্যে। চালককে নিয়ে মোট ন’জন মিলে একটাই অটোর সওয়ার।

লাইনে দাঁড়ালাম। তিন জন ওঠার পরে পিছনের আসনে আর জায়গা নেই বললেই চলে। ‘‘আগুপিছু করে বসুন। অ্যাডজাস্ট করে নিন, আরও এক জন হবে। বিনা বাক্যব্যয়ে ‘অ্যাডজাস্ট’ করলেন যাত্রীরা। এগিয়ে-পিছিয়ে, প্রায় পাশের জনের কোলে উঠে বসে, জায়গা হল চতুর্থ জনের। চালকের বাঁ দিকে আরও দু’জন। চালক ডান দিকে তেরছা হয়ে বসলেন। তবে এতেই শেষ নয়। সপ্তম যাত্রী হিসেবে তখন আমার পালা। অর্থাৎ চালকের ডান দিকে। অটো ছাড়ল, কিন্তু স্ট্যান্ড ছাড়তেই ফের দাঁড়িয়ে পড়ল যাত্রী দেখে। বুঝলাম, আরও এক জন বসবেন আমার ডান দিকে। বসলেনও। চালক তখন আসনে নেই আর, সামনে এগিয়ে গিয়ে কোনও রকমে নিজেকে কেবল ঠেকিয়ে রেখেছেন আসনে। পুলিশ কিছু বলবে না তো? জবাব এল, ‘‘নিশ্চিন্তে থাকুন দিদি, এই রুটে ও-সব কোনও ‘ঝুট-ঝামেলা’ নেই।’’

‘ঝুট-ঝামেলা’ যে নেই, প্রমাণও মিলল অটো একটু এগোতেই। উল্টো দিক থেকে আসা একটি অটোয় চালকের ডান দিকে বসে স্বয়ং পুলিশকর্মী! এ ভাবেই বিনা ‘ঝুট-ঝামেলা’য় দিনের পর দিন অবাধে চলছে ‘মরণ যাত্রা’। আর রাস্তায় কিছু ক্ষণ অন্তরই চোখে পড়ছে পেল্লায় নীল-সাদা সরকারি পোস্টার। তাতে লেখা— সাবধানে চালাও, জীবন বাঁচাও। ভিড়ে ঠাসা অটোচালক আর যা-ই হোক, সাবধানে যে চালাতে পারবেন না— তা বলাই বাহুল্য।

চালককে প্রশ্ন করা হল, এমন বোঝাই অটো চালাতে কোনও সমস্যা হয় না? অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। অভ্যাস হয়েছে যাত্রীদেরও। সামনে দু’জন বসে আছেন দেখেও হাত দেখাচ্ছেন পথে অপেক্ষমাণ যাত্রী। থেমেও যাচ্ছে অটো। ফের ‘অ্যাডজাস্ট’। কোনও অটোয় আবার ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়েও সপরিবার চড়ে বসছেন কেউ। ভয় দূরে থাক, বাচ্চাদের চেপেচুপে কোলে নিয়ে সেই ‘অ্যাডজাস্ট’ করে নিতেই বেশি তৎপর তাঁরা। উৎসাহ দেন চালকও। ‘‘বাচ্চাটাকে কোলে নিন দিদি, হয়ে যাবে আর এক জনের।’’ হয়েও যায়।

প্রশ্ন করা গেল এক স্থানীয় নিত্যযাত্রীকে। নিয়মের তোয়াক্কা না করে এ ভাবে দিনের পর দিন কী করে চলছে অটো? জানা গেল, ছ’জন নেওয়াটাই এখানকার অলিখিত ‘নিয়ম’। জুলপিয়া, ক্যানিং, চম্পাহাটি রুটের অটোগুলি স্ট্যান্ড ছাড়ার পরে সেই সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়ায় নয়েও। গড়িয়া, সোনারপুর, রাজপুর রুটে অবশ্য ততটা ভারী হয় না অটো। ছ’জন নিয়েই চলে তারা। শুধু কলকাতা পুলিশের এলাকায় ঢোকার আগে কেটেছেঁটে চার জন করে নিলেই হল।

এই ছবিটাই কিন্তু অন্য রকম থাকে সকাল সাতটার আগে ও রাত আটটার পরে। সকালের দিকে শহরতলির দিক থেকে গড়িয়ার আশপাশে আসা অটোগুলিতে বারো জন পর্যন্ত লোক নেওয়া হয়, জানালেন খোদ চালকই। কী ভাবে? আট জন বসার পরে আরও চার জন দাঁড়িয়ে যান পিছনের আসনের দু’পাশে ও সামনের আসনের দু’পাশে। এঁদের বেশির ভাগই শহরতলি থেকে শহরে কাজে আসা মানুষ। ফলে সঙ্গের ঝুড়ি, বস্তা, পুঁটুলি— সে সবও সওয়ার হয় একই অটোয়। ছাদে বা পিছনে বেঁধে।

নজরদারি নেই? থেকেও নেই, জানালেন স্থানীয় যাত্রী। ‘স্টার্টার’ হিসেবে স্ট্যান্ডে এক জন উপস্থিত থাকেন ঠিকই, কিন্তু ছ’জন যাত্রী পর্যন্ত কোনও বাধা দেন না তিনিও। আর তার পরের যাত্রীদের তোলা হয় মাঝরাস্তায়। খোদ স্টার্টারকে প্রশ্ন করতে সাফ জবাব, ‘‘কলকাতা পুলিশের নিয়ম এখানে খাটে না।’’

পরিবহণ দফতরের কর্তারাও জানাচ্ছেন, কলকাতা অঞ্চলেই যত নজরদারি, মফস্সল এলাকায় ঢুকলেই তা কার্যত শিথিল হয়ে যায়। রুটেরও কোনও আগা-মাথা নেই। কলকাতায় ১২৫টি অটো রুটের রীতিমতো সরকারি বিজ্ঞপ্তি রয়েছে। কলকাতা ছাড়লে তা-ও নেই। কোন অটো, কোথা থেকে কোথায় যাবে— তা পুরোপুরি পরিবহণ দফতরের আঞ্চলিক অফিস ও সংশ্লিষ্ট এলাকার শাসক দলের নেতারা ঠিক করে নেন। রাজ্য পুলিশের এক কর্তার কথায়, ‘‘যেখানে প্রশাসন আর শাসক দল একমত, সেখানে পুলিশ কী করবে! তা ছাড়া, রাজ্য পুলিশের এলাকায় অটোকে শাসনে আনার মতো পর্যাপ্ত পুলিশ বাহিনীও তো আমাদের হাতে নেই।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Auto Passenger Driver Accident
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE