Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

বদলাচ্ছে ঘুড়ির চেহারা, তবু ফাঁকা আকাশ

ঘুড়ি চোখে পড়ে কদাক্কচিৎ। ছাদে আর দাপিয়ে বেড়ায় না কিশোরের দল। দূর থেকে ভেসে আসে না ‘ভো-কাট্টা’-র সুরেলা উচ্ছ্বাস। ছাদের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত বাঁধা পড়ে না মাঞ্জা লাগানো সুতোয়। মায়েদের সতর্ক দৃষ্টি এখন আর ছাদের কার্নিশে নয়, ছেলের হাতের মোবাইলে।

আধুনিক: কচিকাঁচাদের চোখ টানতে ঘুড়িতে হাজির ডোরেমনও। মেটিয়াবুরুজের একটি দোকানে। ছবি: অরুণ লোধ

আধুনিক: কচিকাঁচাদের চোখ টানতে ঘুড়িতে হাজির ডোরেমনও। মেটিয়াবুরুজের একটি দোকানে। ছবি: অরুণ লোধ

তিয়াষ মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০০:৩৯
Share: Save:

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হওয়ার অপেক্ষা ছিল টুকাই, টিঙ্কু, সোনাইদের। মাদুর বিছিয়ে গড়িয়ে নেওয়া মায়েদের ভাতঘুম তখনও চোখ ছাড়ত না ভাল করে। সন্তর্পণে খাটের তলা থেকে

ঘুড়ির গোছা আর লাটাই বার করে নিয়েই দুদ্দাড় পায়ে ছাদে। শরতের আকাশ তখন আর নীল-সাদার চাঁদোয়া নয়, রীতিমতো রঙিন যুদ্ধক্ষেত্র! লাল-নীল-সবুজ-কালো ঘুড়ির মেলায় বোঝা মুশকিল আকাশের আসল রং। ছুটির দিনে ছদ্ম-শাসনের আবহেই লাটাই ধরতেন দাদা-বাবা-কাকারা। শিখিয়ে দিতেন, ঘুড়ি কাটার গোপন মারপ্যাঁচ। মায়েদের তরফ থেকে শুধুই সাবধানবাণী— ‘‘কার্নিশে ঝুঁকবি না কিন্তু!’’

খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, বড় জোর বছর দশ। তবু কথাগুলো বলতে বলতে স্মৃতির ঝাঁকে বারবার হারিয়ে যাচ্ছিলেন স্বপন দত্ত। যাদবপুর এলাকার এক ব্যবসায়ী। বলছিলেন, শেষ কয়েক বছরে রীতিমতো বদলে গিয়েছে শরৎ-বিকেলের আকাশ। ঘুড়ি চোখে পড়ে কদাক্কচিৎ। ছাদে আর দাপিয়ে বেড়ায় না কিশোরের দল। দূর থেকে ভেসে আসে না ‘ভো-কাট্টা’-র সুরেলা উচ্ছ্বাস। ছাদের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত বাঁধা পড়ে না মাঞ্জা লাগানো সুতোয়। মায়েদের সতর্ক দৃষ্টি এখন আর ছাদের কার্নিশে নয়, ছেলের হাতের মোবাইলে। নীল তিমি লুকিয়ে নেই তো!

রবিবার, বিশ্বকর্মা পুজোর দিনের আকাশও সে কথাই জানিয়ে দিল। সকাল থেকে ধূ ধূ করছে খালি আকাশ। পাড়ায় পাড়ায় ভেসে আসছে না ভো-কাট্টা। মোড়ে মোড়ে বাজানো উত্তাল ডিজে আর বাস-অটোয় লাগানো ফুল-পাতার বাহার ছাড়া বোঝার উপায় নেই বিশ্বকর্মা পুজো বলে। এই পুজোর সব চেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ঘুড়ির অস্তিত্বই যেন শহর থেকে বিলুপ্ত হতে বসেছে। বিকেলের দিকে কিছু ঘুড়ি চোখে পড়লেও, সংখ্যায় নিতান্তই কম।

তবে এত সহজে হাল ছাড়তে রাজি নন স্বপনবাবুদের মতো ব্যবসায়ীরা। গড়িয়াহাটের ব্যবসায়ী তরুণ নস্কর যেমন বলছিলেন, ‘‘সময় বদলাবে, বাচ্চাদের পছন্দও বদলাবে। যখন প্রথম ভিডিও গেম বাজারে এসেছিল, তখনও এক ধাক্কায় বেশ ফাঁকা হয়েছিল ঘুড়ির আকাশ। কিন্তু এখনকার মতো এতটা নয়।’’ তাই বাচ্চাদের মধ্যে ঘুড়ির চাহিদা কমে গেলেও, পিছু হটছেন না ব্যবসায়ীরা। বরং তাঁরা নিত্য নতুন ভাবে পথ খুঁজছেন মনোরঞ্জনের।

আর এই ধারণা থেকেই ঘুড়ির চৌখুপি ছাঁদ ভেঙে যাচ্ছে। পেটকাটি-মোমবাতি-বগ্গা-চাঁদিয়ালের জায়গা নিয়ে নিচ্ছে, সুপারম্যান-ব্যাটম্যান-ছোটা ভীম-পিকাচু-ডোরেমনের দল। নানা রকম ছবিতে, আকারে, আকৃতিতে, মাপে বদলে যাচ্ছে ঘুড়ির পরিচিত চেহারা। কোনও ঘুড়ি এরোপ্লেনের মতো দেখতে, কোনওটা বা মিকি মাউস। দামও বাড়ছে চড়চড়িয়ে। পনেরো, কুড়ি, তিরিশ হয়ে পঞ্চাশ পর্যন্ত ছুঁয়েছে নতুন এই ঘুড়ির দাম। এখন আর চৌকো করে কাটা একরঙা পাতলা কাগজে কোণাকুণি কাঠি সেঁটে দিলেই মনোহর ঘুড়ি তৈরি হয় না। অভিনবত্বের দৌড় সীমাবদ্ধ নেই শুধু ল্যাজের বাহারে। প্রতিযোগিতা এ বার ঘুড়ির মধ্যে নতুন চেহারা ফুটিয়ে তোলার। আর তা যতটা ব্যবসায়িক লাভের জন্য, তার চেয়ে বেশি ঘুড়ি-শিল্পকে টিকিয়ে রাখার। শৈশব-কৈশোরে ঘুড়ির স্মৃতি হারিয়ে যেতে না দেওয়ার লড়াই চলছে জোরদার।

তবে এই সব নতুন ধরনের ঘুড়ি যতটা ঘর সাজানোর জন্য বিক্রি হচ্ছে, ততটা ওড়ানোর জন্য নয়। নজরকাড়া চেহারা দেখে অনেক খুদেই হয়তো বায়না করছে ঘুড়ি কেনার। কিন্তু ছাদে গিয়ে সে ঘুড়ি আর
ওড়ানো হয় না। লাটাই ধরবে কে, শেখাবেই বা কে?

সন্তোষপুরের সদ্য কলেজে-পা আর্যনীল বলছিলেন, ‘‘ছোটবেলায় হাঁ করে অপেক্ষা শুরু হতো বর্ষার পর থেকেই। বাবার মানিব্যাগ থেকে খুচরো পয়সা চুরি করতাম ঘুড়ি-লাটাই কেনার। অন্য পাড়ার ঘুড়ি কেটে নিজের ছাদে পড়লে মনে হতো সেই দিনের জন্য রাজা হয়ে গিয়েছি। এখন কই দেখি ঘুড়ি?’’ আর্যনীলের ভাই শুভ্র ক্লাস সেভেনে। মোটেও ওড়ায় না ঘুড়ি। জিজ্ঞেস করতে বলল, ‘‘স্কুল-টিউশন-ক্যারাটে-সাঁতার... ফাঁকা বিকেল পাই কোথায়, যে ঘুড়ি ওড়াব? সময় পেলে মায়ের মোবাইলে গেম খেলি।’’

শুভ্রদের কথা ভেবেই লেক মার্কেটের এক ব্যবসায়ী চন্দন গুপ্তর আক্ষেপ, ‘‘ছাদ কই? সময়ই বা কই? এ বার আর আকাশে নয়, মোবাইলেই হয়তো উড়বে ঘুড়ি। নতুন গেম এলো বলে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE