সেই নিমের দাঁতন।
শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত বড়সড় একটি অ্যাম্বুল্যান্স। মাথায় নীল বাতি জ্বলছে। চালকের সামনের কাচে লেখা ‘কেএমসি’। অ্যাম্বুল্যান্সের পিছনে লেখা, জোড়াসাঁকো কেন্দ্রের বিধায়ক দীনেশ বজাজের তহবিল থেকে ওই অ্যাম্বুল্যান্সটি দেওয়া হয়েছে। সোমবার রাত আটটা নাগাদ শিয়ালদহ উড়ালপুল সংলগ্ন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোডের এক পাশে এসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল অ্যাম্বুল্যান্সটি। আচমকা রাস্তার পাশে অ্যাম্বুল্যান্স দাঁড়িয়ে যাওয়ায় কৌতূহলবশত এগিয়ে গিয়েছিলেন সেখানে কর্তব্যরত ট্রাফিক সার্জেন্টও।
কেন দাঁড়িয়ে অ্যাম্বুল্যান্স? গলায় গামছা ঝোলানো চালককে জিজ্ঞেস করেও কোনও উত্তর আসছিল না। চালক মুখ ঘুরিয়ে বসে। অগত্যা অ্যাম্বুল্যান্সের পিছনের দরজা খুলে রোগীর খোঁজ করতে যেতেই হতভম্ব ওই সার্জেন্ট। অ্যাম্বুল্যান্সের পিছনের দরজা খোলার পরে রোগীর জায়গায় ধুপধাপ করে বেরিয়ে এল নিমের দাঁতন। অ্যাম্বুল্যান্স-বোঝাই শুধুই নিমের দাঁতন। ফের চালককে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলেন সার্জেন্ট। কিন্তু চালক অ্যাম্বুল্যান্স থেকে নামতেই চান না। শেষে ধমকে-চমকে তাঁকে জোর করে নামানো হল।
সার্জেন্ট: নাম?
চালক: বিশ্বেশ্বর রাও।
সার্জেন্ট: গাড়ির কাগজপত্র কোথায়?
চালক: কলকাতা পুরসভার মেয়রের টেবিলে রয়েছে।
সার্জেন্ট: রোগী নেই। কোথা থেকে নিমের দাঁতন নিয়ে এসেছ?
চালক: আমডাঙা।
অ্যাম্বুল্যান্সের চালক।
বিশ্বেশ্বর রাওকে জিজ্ঞাসাবাদের ফাঁকেই আশপাশে গামছা কাঁধে, চটের বস্তা হাতে আরও কয়েক জন হাজির। হাত জোড় করে তাঁদেরই এক জন এগিয়ে এলেন ‘সার্জেন্ট সাহেবের’ কাছে। ‘‘স্যার, বিশু (চালক) আমাদের দাঁতন নিয়ে এসেছে। তবে আমডাঙা থেকে আনা হয়নি। বহরমপুর থেকে আনা হয়েছে। আমরা পেটের দায়ে করে খাই স্যার। কলকাতার নানা জায়গায় ওই নিমের দাঁতন বিক্রি করি।’’ গামছাধারীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গিয়েছে, বহরমপুর থেকে নিমের দাঁতন আনার গাড়ি ভাড়া তিন হাজার টাকা।
জিজ্ঞাসাবাদের পরে চালকের লাইসেন্স নিয়ে মামলা দায়ের করা হয়েছে। পুলিশ জেনেছে, বছরখানেক ধরে সপ্তাহে এক দিন ওই অ্যাম্বুল্যান্সে চাপিয়ে নিমের দাঁতন নিয়ে আসে বিশু। ডব্লিউবি২৫ই ১৫৯৬ নম্বরের অ্যাম্বুল্যান্সটির মালিকের খোঁজ শুরু করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তদন্তকারীরা। পুলিশ সূত্রের খবর, বারাসত মোটর ভেহিক্লস থেকে রেজিস্ট্রেশন করানো অ্যাম্বুল্যান্সটির সঙ্গে কলকাতা পুরসভার যোগ নেই বলেই মনে করা হচ্ছে।
প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে পুলিশের অনুমান, অ্যাম্বুল্যান্সটি ভাড়ায় দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
লালবাজারের এক কর্তার কথায়, ‘‘অ্যাম্বুল্যান্সের মাধ্যমে নানা বেআইনি কাজের অভিযোগ থাকে। সে ক্ষেত্রে অ্যাম্বুল্যান্সের উপরেও কড়া নজরদারি থাকে। রোগী নেই, অথচ নীলবাতি ও হুটার বাজিয়ে অনেক অ্যাম্বুল্যান্স চলাচল করে। সব ক্ষেত্রেই আমরা নজরদারি করি। এই ঘটনাটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে সবক’টি রাজ্যের সরকারকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, কোনও বিধায়ক ও সাংসদ তহবিল থেকে বেসরকারি সংস্থাকে অ্যাম্বুল্যান্স প্রদান করা যাবে না। রোগী পরিষেবার বদলে নানা ভাবে অ্যাম্বুল্যান্সের মাধ্যমে ব্যবসা করা হচ্ছে বলে মনে করছেন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের কর্তারা। তার প্রেক্ষিতেই এই নির্দেশ।
কলকাতা পুরসভার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এটি পুরসভার অ্যাম্বুল্যান্স হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। তা সত্ত্বেও ওই অ্যাম্বুল্যান্সের নম্বরটি খতিয়ে দেখা হবে। পুলিশও তদন্ত করুক।’’ অন্য দিকে, যাঁর তহবিল থেকে অ্যাম্বুল্যান্সটি দেওয়া হয়েছে বলে লেখা রয়েছে, সেই প্রাক্তন বিধায়ক দীনেশ বজাজ বলেন, ‘‘আমিও অ্যাম্বুল্যান্সটির নম্বর সংগ্রহ করছি। পুলিশও তদন্ত করছে। কারা এ সব করছে, তা খতিয়ে দেখছি।’’
— নিজস্ব চিত্র
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy