Advertisement
০৫ ডিসেম্বর ২০২৩
Female Cab Driver Dipta Ghosh

সফ্‌টঅয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হয়ে রাস্তায় রাস্তায় গাড়ি চালাস? প্রশ্ন শোনেন কলকাতার ‘ক্যাব-কন্যা’, কিন্তু দমেন না

ইচ্ছা ছিল পুলিশ অফিসার হবেন। বাড়িতে সকলের ইচ্ছায় হয়ে যান সফ্‌টঅয়্যার ইঞ্জিনিয়র। কিন্তু চাকরি করলে আবার চলে যেতে হবে বাংলার বাইরে! তাই গাড়ি কিনে ক্যাবের চালক হয়ে গিয়েছেন দীপ্তা।

Dipta Das female cab driver of Kolkata

কলকাতার ক্যাব-কন্যা দীপ্তা ঘোষ। — নিজস্ব চিত্র।

পিনাকপাণি ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০২৩ ১৫:২৪
Share: Save:

ভাল চাকরি নিয়ে বাংলার বাইরে কাজ করাই যেত। কিন্তু মায়ের একাকিত্ব, ছোট বোনের লেখাপড়া দেখবে কে? বড় মেয়ে হিসাবে মৃত বাবার অপূর্ণ কাজ তো তাঁকেই করতে হবে! তাই চাকরির চেষ্টা ছেড়ে অ্যাপ ক্যাবের স্টিয়ারিং ধরেছেন দীপ্তা। রাস্তায় কখনও ‘ডব্লু বি ০৫-৮১৯৮’ ক্যাব দেখলে জানবেন, চালকের আসনে বসে আছেন জলপাইগুড়ি গভর্নমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রাক্তন ছাত্রী দীপ্তা ঘোষ।

বাঁশদ্রোণীর বাসিন্দা দীপ্তার সঙ্গে আনন্দবাজার অনলাইনের সাক্ষাৎ পথেই। তাঁর গাড়িতে যেতে যেতেই কথা শুরু। তাঁর লেখাপড়া থেকে এখনকার জীবনের গল্প। জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে বি টেক করার আগে কলকাতার জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ পলিটেকনিক থেকে ইলেকট্রনিক্স ও টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে ডিপ্লোমা করেন। তবে প্রথম থেকেই ঠিক করে রেখেছিলেন, চাকরি করতে বাংলার বাইরে যাবেন না। বাবা মোহিতকুমার ঘোষও ইঞ্জিনিয়র ছিলেন। জীবনের প্রায় সবটাই কেটেছে রাজ্যে রাজ্যে। বাবার জীবন চাননি দীপ্তা। আর বাবা মারা যাওয়ার পরে মা’কে ছেড়ে যাওয়ার কথা আর মাথাতেই আসেনি। কলকাতায় তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে চাকরি নেই তা নয়, কিন্তু সেখানেও বদলির সম্ভাবনা প্রচুর। তাই দীপ্তা ভেবেছিলেন, এমন স্বাধীন কিছু করতে হবে, যাতে মা’কে ছেড়ে দূরে কোথাও যেন চলে যেতে না হয়।

Dipta Das female cab driver of Kolkata

যাত্রীদের গন্তব্যে পৌঁছনোই দীপ্তার জীবনের গন্তব্য। ছবি: সংগৃহীত।

দীপ্তা জানিয়েছেন, তাঁর সেই ভাবনার সবচেয়ে বড় সঙ্গী হয়েছিলেন তাঁর মা। লেখাপড়া শেষে কিছু দিন চাকরি করে কিছু টাকা জমাতে পেরেছিলেন দীপ্তা। নিজের জমানো টাকা দিয়েছিলেন তাঁর মা পদ্মশ্রী ঘোষ। দীপ্তা কিনে ফেলেন একটা সাদা রঙের গাড়ি। যার ‘সারথি’ তিনি নিজে। অ্যাপের মাধ্যমে যাত্রী পাওয়া কঠিন নয়। ফলে মাসের শেষে তেল আর গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণের খরচা সামলেও ভাল আয়। মা-মেয়ের জীবন এখন বেশ আনন্দের। দীপ্তার বোন আগেই চাকরি পেয়ে গিয়েছেন। বিয়েও হয়ে গিয়েছে। দীপ্তার কথায়, ‘‘কলকাতায় মেয়ে ক্যাবচালক খুবই কম। নেই বললেই চলে। সকলের মা তো আমার মায়ের মতো নন! আমার মনে হয়, মায়েরা সাহস না দিলে, পাশে না থাকলে কোনও মেয়ের পক্ষে ‘পুরুষের কাজ’ হিসাবে পরিচিত ক্যাবচালক হওয়া সহজ নয়।’’

ক্যাব চালাতে গিয়ে নানা রকম সমস্যার সম্মুখীন হতেই হয়। তবে যাত্রীদের নিয়ে তেমন অখুশি নন দীপ্তা। যদিও তাঁর দাবি, ‘‘পুরুষ যাত্রীরা প্রায় সবাই ভাল ব্যবহার করেন। যেটুকু খারাপ ব্যবহারের মুখোমুখি হতে হয়, সেটা মূলত মহিলা যাত্রীদের থেকে। তবে সেই সংখ্যাও খুব বেশি নয়।’’

দিনে গাড়ি চালালেও দীপ্তা রাতে গাড়ি চালান না। তবে ভয়ে নয়, মায়ের পাশে থাকতে হবে বলে। বলেন, ‘‘রাতের কলকাতা নিরাপদ কি না বলতে পারব না। এ ব্যাপারে আমার খারাপ-ভাল কোনও অভিজ্ঞতাই নেই।’’ তবে কলকাতা পুরসভার শৌচাগার নিয়ে তাঁর বিস্তর অভিযোগ। বললেন, ‘‘বেশির ভাগই বড্ড নোংরা। তবে আমি কোনগুলো ভাল সেটা জানি। ফলে দরকার মতো গাড়ি ঘুরিয়ে সে দিকে চলে যাই।’’

মেয়ে হিসাবে ক্যাব চালানোর অন্য সমস্যার কথাও শোনা গেল, ‘‘ফোন করে গন্তব্য জানতে চাইলে গলা শুনেই অনেকে ট্রিপ ক্যানসেল করে দেন। কেউ আবার প্রশ্ন করেন, আপনি কি ড্রাইভারের অ্যাসিস্ট্যান্ট, না কি ট্রান্সজেন্ডার?’’ দীপ্তার অভিজ্ঞতা বলছে, মেয়েরাই নাকি বেশি করে মেয়ে ক্যাবচালক এড়িয়ে যান। তবে গাড়ি চালানোর থেকে বেশি সমস্যা গাড়ি সারাতে। দীপ্তার কথায়, ‘‘গ্যারাজে গেলে গাড়ি ছেড়ে সকলে আমায় দেখতে থাকেন। আসলে একটা মেয়ে হলুদ নম্বর প্লেটের গাড়ি নিয়ে এসেছে, এটা কেউ ভাবতেই পারেন না! আর বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের থেকে ‘সফ্‌টঅয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হয়ে রাস্তায় রাস্তায় গাড়ি চালাস?’ প্রশ্ন শুনে তো কান পচে গিয়েছে!’’

তবে তাতে দমেন না দীপ্তা। তাঁর কথায়, ‘‘যতই বাধা আসুক, প্রশ্ন আসুক, আমি গাড়ি চালিয়ে যাব। চাকার আবিষ্কার সভ্যতার চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছিল। আমার চাকাও ঘুরছে, ঘুরবে।’’ এখন আর চাকরিবাকরির কথা ভাবতেও পারেন না তিনি। ছেলেবেলায় ইচ্ছা ছিল, বড় হয়ে পুলিশ অফিসার হবেন। কিন্তু বাড়ির ইচ্ছায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে হয়েছে। এখন আর ও সব নিয়ে ভাবতে চান না দীপ্তা। ঠিক করে ফেলেছেন, মানুষকে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়াই তাঁর জীবনের গন্তব্য।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:
Advertisement

Share this article

CLOSE