Advertisement
E-Paper

সোশ্যাল মিডিয়া মানেই কি ‘যেমন খুশি’ বলার

খুল্লমখুল্লা যা ইচ্ছে লিখে ফেলাটাই ভাল? নাকি খানিকটা লাগাম টানাও জরুরি? ফেসবুকে ‘বাকস্বাধীনতা’ কি সত্যিই স্ফুলিঙ্গ ছড়ায় সমাজে? তর্ক-বিতর্ক, যুক্তি-পাল্টা যুক্তিতে সরগরম আশুতোষ কলেজ। সঙ্গে ছিলেন পরমা দাশগুপ্ত।খুল্লমখুল্লা যা ইচ্ছে লিখে ফেলাটাই ভাল? নাকি খানিকটা লাগাম টানাও জরুরি? ফেসবুকে ‘বাকস্বাধীনতা’ কি সত্যিই স্ফুলিঙ্গ ছড়ায় সমাজে? তর্ক-বিতর্ক, যুক্তি-পাল্টা যুক্তিতে সরগরম আশুতোষ কলেজ। সঙ্গে ছিলেন পরমা দাশগুপ্ত।

শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০১৬ ০২:৪৭

অঙ্কিতা: আমাদের প্রজন্মটা স্বাধীন মতামত দেওয়ায় বিশ্বাসী। ফেসবুক সেটারই সুযোগ করে দেয়। মিডিয়া তো আর সব কিছু বলে না, বলতে পারেও না। তবে ভাষার ব্যবহার নিয়ে নিশ্চয়ই সতর্ক থাকা উচিত। এখন তো সব বয়সের মানুষই ফেসবুক করেন, বাচ্চা থেকে বয়স্ক, সকলেই।

সুদেষ্ণা: ফেসবুকে সব লিখে ফেলা যায়। নিশ্চয়ই লিখব। কিন্তু সেটা যদি কারও সেন্টিমেন্টে আঘাত করে? সেটা কি ঠিক? বাক স্বাধীনতা থাক, কিন্তু একটা ফিল্টারও তো বোধহয় জরুরি। খবরের কাগজ যেটা করে— ধর্ম, বিশ্বাস বা সেন্টিমেন্টে আঘাত দেওয়া এড়িয়ে চলে। আমার মনে হয়, ফেসবুকেও সেটা মানা উচিত।

অমৃত: কী ঝামেলা! বন্ধুরা বন্ধুকে যা খুশি বলে না? কে কী ভাবে নেবে, সেটা তো তার ব্যাপার! কোনও কিছু নিয়ে ফেসবুকে এক জন মজা করে কিছু লিখল, অন্য জন সেটা ভাল মনে নেবে নাকি রেগে যাবে, সেটা তো তার উপরে নির্ভর করে। ওই ভাবে কি ফিল্টার করা যায়? অনেকেই বলতে পারে, এটা বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা।

নিরঙ্কুশ: কিন্তু ফেসবুকে লিখে কি সত্যিই কিছু হয়? খবরের কাগজে লেখা হলে বা টিভি চ্যানেলে দেখালে তা-ও মানে ছিল। ফেসবুকে এক দিন প্রতিবাদ হয়, তিন দিন সেটা শেয়ার হয়, তার পরে আবার যে কে সেই! লোকে ভুলে যায়। কাজের কাজ কিছু হয় কি? ফেসবুকটা এন্টারটেনমেন্ট-এর জায়গা।

বিজয়: এগ্‌জ্যাক্টলি! যেখানে লেখার কথা, সেখানে লেখা হয় না। যেখানে লিখে লাভ নেই, সেখানে লোকে লিখে লিখে পাহাড় করে ফেলে!

শ্রুতি: খবরের কাগজে ও রকম যা ইচ্ছে তাই লিখে ফেলা যায় না। প্রতিবাদ, বিক্ষোভ বা ঝামেলা হলে সামলাবে কে? সে জন্যই ভেবেচিন্তে ওরা সেনসিটিভ বিষয়গুলো এড়িয়ে যায়। সেখানেই ফেসবুক প্ল্যাটফর্ম হয়ে যায়।

নিরঙ্কুশ, বিজয়: কিন্তু ফেসবুকে লিখে আল্টিমেটলি যদি লাভই না হয়, লিখে হবেটা কী? খবরের কাগজ পুরোটা সামনে না আনুক, কিছুটা তো আনে।

শ্রুতি, অঙ্কিতা: মিডিয়া কোনও দিনই খাঁটি সত্যির পুরোটা সামনে আনতে পারবে না। আর তা ছাড়া ভেবে দেখ, আমাদের বয়সী ক’জন আর এখন খবরের কাগজের পুরোটা খুঁটিয়ে পড়ে এখন?

নিরঙ্কুশ: অফকোর্স পড়ে। আমাদের জেনারেশন অ্যাপে খবর পড়ে। পড়া দিয়ে তো কথা। আর সেই অ্যাপের পোস্ট ফেসবুকেও পাওয়া যায়। ফেসবুক করতে করতে সেই লিঙ্কগুলো কি আমরা পড়ি না?

শ্রুতি: কিন্তু মিডিয়ার কিছু বাধ্যবাধকতাও থাকে। ওরা যেটা লিখতে বা বলতে পারে না, সেটা সাধারণ মানুষ ফেসবুকে খোলাখুলি লেখে।

নিরঙ্কুশ: আরে, লিখে যদি লাভ না হয় তা হলে লেখার দরকার কী? পার্ক স্ট্রিটের সেই ধর্ষণের ঘটনাটা মনে আছে? ফেসবুকে এত লেখালেখি হল, ক্যান্ডেললাইট মার্চ হল। তাতে কতটা লাভ হয়েছিল তখন? এখনই বা
কতটা হয়েছে?

সুদেষ্ণা: ফেসবুকে লেখার সময়ে ভাবা উচিত সেটা কার কাছে কী ভাবে পৌঁছবে। একটা দল অন্য দলের সেন্টিমেন্ট বা মেন্টালিটিটা বুঝতে না চেয়ে কিছু লিখে ফেললে সমস্যা হবেই। আর তা ছাড়া, ফেসবুকের পোস্টে কত বিতর্কেরও সৃষ্টি হয়। সেই জায়গা থেকেই ফেসবুকে লেখার ক্ষেত্রে কোথায় দাঁড়ি টানতে হবে, সেটা বোঝা উচিত নয় কি? আর যাদের কাজ

অমৃত: কিন্তু নিরঙ্কুশ যেটা বলছিল, ফেসবুকে লেখা সবই ইউজলেস, আই বেগ টু ডিফার। এখনকার অনেক আন্দোলনই কিন্তু ফেসবুক থেকে শুরু হয়েছে। ফেসবুকে লেখার ইমপ্যাক্টটা কিন্তু অস্বীকার করার নয়। মানুষকে একজোট করতে যথেষ্ট কাজে লাগে এই প্ল্যাটফর্মটা। পার্ক স্ট্রিটের ক্ষেত্রেও কিন্তু সেটা হয়েছিল।

সুদেষ্ণা: লং টার্ম এফেক্ট কই? তিন দিন ঝড় উঠল, চার দিনের দিন থেমে গেল। লোকে ভুলেও গেল তার পরে। তাতে লাভ আছে কি? খবরের কাগজ বা টিভি নিউজ কিন্তু অনেক বেশি লোক পড়ে বা শোনে।

অমৃত: নির্ভয়া-কাণ্ড কি ভুলে গিয়েছিল লোকে? দিল্লি থেকে গোটা দেশে আন্দোলনটা ছড়াতে ফেসবুকের ভূমিকাটা অস্বীকার করতে পারবি?

শ্রুতি, অঙ্কিতা: তা ছাড়া, কী হবে-কত দূর হবে, সেটা প্রশাসনের দায়িত্ব। অন্তত সাধারণ মানুষকে একজোট করার কাজটা যে ফেসবুক করে দিচ্ছে, সেটাই তো অনেক বড় কাজ।

নিরঙ্কুশ: আর মাস মিডিয়া কিছু করেনি? খবরের কাগজ, টিভি কিছু করেনি?

রাজ: ফেসবুক কিন্তু সমাজের একটা ছোট্ট অংশের, এই প্রজন্মের হাতিয়ার। বাকিরা মিডিয়ার উপরেই নির্ভর করে। মিডিয়াই তাদের হয়ে কথা বলে। আর ফেসবুকে যারা কমেন্ট করে, তারা অনেক ক্ষেত্রে রেসিস্ট কমেন্ট করে বসে, পুরোটা না জেনে না বুঝে সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্ট হয়ে লিখে ফেলে। তোদের কি মনে হয় সব জেনেশুনে তার পরে ওই কমেন্টগুলো করা হয়?। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে যে ছেলেটা বন্ধুর বাড়ির পার্টিতে গিয়ে মারা গেল, তার পরে যত লোক লিখেছিল, কমেন্ট করেছিল, শেয়ার করেছিল, সবাই কি সবটা জেনে করেছে? ডেফিনেটলি না। আমার মনে হয়, ফেসবুকটাকে শুধু এন্টারটেনমেন্ট হিসেবে ব্যবহার করাই ভাল। ছবি, গান পোস্ট কর, মজার মজার জিনিস লেখ, ফিলিংস শেয়ার কর ব্যস! বিপ্লব করার জায়গা এটা নয়।

সুদেষ্ণা: ফেসবুকের তিন দিনের উত্তেজনা। মিডিয়ার ইমপ্যাক্টটা কিন্তু অনেক দিন থাকে।

শ্রুতি: ঠিক আছে না হয়, এন্টারটেনমেন্টই হল। কিন্তু খবরের কাগজও কি একটা ঘটনা নিয়ে মাসের পর মাস লেখে?

অঙ্কিতা: পার্ক স্ট্রিটের ধর্ষণ নিয়ে ফেসবুক কটা লোকের কাছে পৌঁছেছে? আর খবরের কাগজ ক’টা লোকের কাছে পৌঁছেছে?

অমৃত: কিন্তু মিডিয়া মানুষকে কতটা একজোট করে এ সব ক্ষেত্রে?

রাজ, সুদেষ্ণা: ‘হোক কলরব’ কত দিন চলেছে? এক মাস? এখনও আদৌ অনেক জন লোক জানেই না। কানহাইয়া কুমারকেই বা ক’জন চিনেছে? ফেসবুকে তো এত আলোড়ন হয়েছিল।

শ্রুতি, অঙ্কিতা: সোশ্যাল মিডিয়া আর মিডিয়া তো মার্জও করা যায়। সেটাও মাস মিডিয়া-ই হয়ে যাবে।

সুদেষ্ণা: ফেসবুকে যা লেখা হয়, সেটা কি মিডিয়ায় আনা যায় সব সময়ে? মাঝে এক জন স্টুডেন্টকে নিয়ে

অমৃত: মুম্বইয়ের জঙ্গিহানা নিয়ে এত লেখা হয়েছিল। চার জন জঙ্গির নামও বহু বার ছাপা হয়েছিল। মনে আছে তাদের নামগুলো?

শ্রুতি: ঘটনাটা তো মনে আছে? আর ঘটনাটা কলকাতায় হলে হয়তো নিশ্চয়ই মনে থাকত।

রাজ: ধরা যাক, আমাদের কলেজের সামনে একটা কোনও নিগ্রহের ঘটনা ঘটল। পুলিশের কাছে যাব? নাকি মার্ক জুকেরবার্গকে বলব?

শ্রুতি, অঙ্কিতা: তবে পুলিশের ফেসবুক পেজ কিন্তু কাজ করে। অ্যাকশনও নেওয়া হয়। ফেসবুকে ‘হোক কলরব’ দানা বেঁধেছিল। তার ইমপ্যাক্টে কিন্তু ভিসি-কে সরতেও হয়েছিল।

রাজ: আচ্ছা, বেশ! এই তো দু’দিন আগে এত বড় একটা ট্রেন দুর্ঘটনা হল, ক’টা লোক তা নিয়ে লিখেছে? কিন্তু দেখুন ঐশ্বর্যা কী করছে, করিনা কেমন আছে, তা নিয়ে অসংখ্য পোস্ট আছে।

অঙ্কিতা: ফেসবুক ইনফর্মেশন দেয়, এটা কিন্তু অস্বীকার করলি না!

সুদেষ্ণা: আর গুজবের ক্ষেত্রে? এই যে নোট বাতিলের সময়ে নুন নিয়ে গুজবটা হল, তা যদি ফেসবুকে লোকে লিখে যেত, কী হতো ভাবতে পারিস? কলকাতাতেও নুনের ক্রাইসিস হতো।

শ্রুতি: সেটা তো খবরের কাগজও লেখেনি। কোনটা লেখা যায়, আর কোনটা যায় না, সেটা তো নিজেকেই ঠিক করতে হবে।

রাজ: আসল কথা হল— মিডিয়া আর সোশ্যাল মিডিয়া দুটোই প্ল্যাটফর্ম। কিন্তু সেগুলোর সঠিক ব্যবহারটা না জানলে মুশকিল। কী লিখতে হবে, কতটা লিখতে হবে, কোথায় দাঁড়ি টানতে হবে, সেটা বোঝার মতো ক্ষমতা না থাকলে সবটাই মাটি!

ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

Students Social Media right to freedom of speech
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy