Advertisement
০৫ মে ২০২৪

পুজোর লড়াইয়ে এ বার নজর কেড়েছেন নবীনরাই

পুজোয় এ বার ‘পরিবর্তনের’ হাওয়া! সেই হাওয়া গায়ে লাগিয়েই শহরের পুজোয় উঠে এসেছেন নতুন তারকারা। এত দিন পুজোর সময়ে ভিড়ের বেশির ভাগটাই নিজেদের দিকে টেনে নিতেন শহরের প্রতিষ্ঠিত শিল্পীরা। কেউ কেউ নবীনদের কাজ দেখে তারিফ করলেও আমজনতা বা পুরস্কারদাতারা নবীনদের থেকে মুখ ফিরিয়েই থাকতেন। এ বার অবশ্য সেই ধারায় বদল এসেছে। উৎসব কাপে ভিড় হোক বা পুরস্কারের লড়াই, শহরে নবীনদেরই জয়জয়কার।

কাঁকুড়গাছি যুবকবৃন্দের মণ্ডপ

কাঁকুড়গাছি যুবকবৃন্দের মণ্ডপ

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০১৪ ০১:৩৪
Share: Save:

পুজোয় এ বার ‘পরিবর্তনের’ হাওয়া! সেই হাওয়া গায়ে লাগিয়েই শহরের পুজোয় উঠে এসেছেন নতুন তারকারা। এত দিন পুজোর সময়ে ভিড়ের বেশির ভাগটাই নিজেদের দিকে টেনে নিতেন শহরের প্রতিষ্ঠিত শিল্পীরা। কেউ কেউ নবীনদের কাজ দেখে তারিফ করলেও আমজনতা বা পুরস্কারদাতারা নবীনদের থেকে মুখ ফিরিয়েই থাকতেন। এ বার অবশ্য সেই ধারায় বদল এসেছে। উৎসব কাপে ভিড় হোক বা পুরস্কারের লড়াই, শহরে নবীনদেরই জয়জয়কার।

গত কয়েক বছর ধরেই শহরের নানা পুজোয় নতুন ধরনের কাজ দেখিয়েছিলেন শিল্পী অনির্বাণ দাস। বছর তিনেক আগে দমদম পার্কে মধুবনী ঘাসের কাজ দেখিয়ে অনেকেরই তারিফ কুড়িয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এত কাজের পরেও বড় ক্লাবের কর্তারা অনির্বাণের দিকে বিশেষ ঘুরে তাকাতেন না। এ বছর অবশ্য সবাইকে পিছনে ফেলে তিনিই সেরা। কাঁকুড়গাছি যুবকবৃন্দের পুজোয় তাঁর ‘রথ-শিল্প’ নজর কেড়েছে সবার। নবমীর মাঝরাত পেরিয়েও কাঁকুড়গাছির ভিড় কমেনি। অনেকে অবশ্য বলছেন, অনির্বাণ শুধু কাঁকুড়গাছি নয়, আলিপুর সর্বজনীন ও পাতিপুকুর বসাকবাগানের পুজোতেও লোক টেনেছেন।

শহরের নামী শিল্পী সনাতন দিন্দার উত্থান হাতিবাগানের নলিন সরকার স্ট্রিট থেকেই। এক সময় সনাতনের কাজ দেখতেই ভিড় উপচে পড়ত সেখানে। ‘ঘরের ছেলে’ সনাতন অবশ্য এখন দক্ষিণের বড় ক্লাবের পুজোয় চলে গিয়েছেন। গত দু’বছর সে ভাবে ভিড় টানতে পারেনি নলিন সরকারও। বাধ্য হয়ে এ বার তাঁরাও উঠতি শিল্পী পরিমল পালের হাত ধরেছিলেন। আয়নায় সাজানো মণ্ডপ তো ছিলই, এ বার লোকের নজর কেড়েছে নলিন সরকারে পরিমলের প্রতিমা। দক্ষিণের সন্তোষপুর লেকপল্লিতেও প্রতিমা গড়েছিলেন এই শিল্পী। নলিন সরকারের মতো সেখানেও একাধিক পুরস্কার জিতে নিয়েছেন তিনি। উত্তর-দক্ষিণ মিলিয়ে প্রতিমায় এমন সাফল্য বিরল বলেই দাবি করছেন পুজোকর্তারা।

হাতিবাগানের নবীন পল্লি, বড়িশা ক্লাব, সন্তোষপুর অ্যাভিনিউ সাউথ, এন্টালির ২০ পল্লি ভরসা রেখেছিল নতুনদের উপরেই। গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজের ভাস্কর্যের ছাত্র মহেন্দ্র পাল নবীন পল্লিতে বিষ্ণুপুরের মৃন্ময়ী মায়ের ধাঁচে প্রতিমা গড়ে তাক লাগিয়েছেন। এন্টালি ও অ্যাভিনিউ সাউথে রিন্টু দাসের মণ্ডপসজ্জা নজর কেড়েছে। উল্টোডাঙার তেলেঙ্গাবাগানে আশিস চৌধুরীর কাজ দেখতেও ভিড় হয়েছে।

বড়িশা ক্লাবে প্রদীপ দাস কিংবা বুড়োশিবতলা জনকল্যাণ সঙ্ঘের পুজোয় শক্তি শর্মার কাজ দেখতেও ভিড় হয়েছে। শক্তি এত দিন শিল্পী রূপচাঁদ কুণ্ডুর সহকারী ছিলেন। এ বারই প্রথম স্বাধীন ভাবে কাজ করেছেন তিনি। শহরে নজর কেড়েছে নেপাল ভট্টাচার্য স্ট্রিটে কাঞ্চী পালের কাজও।

এ বার নতুন ধরনের কিছু কাজ দেখার সুযোগ জুটেছে। বকুলবাগান সর্বজনীনে প্রতিমা গড়েছেন শিল্পী পরেশ মাইতি। নিয়মিত পুজোর শিল্পীদের পাশাপাশি পরেশবাবুর কাজ স্বাভাবিক ভাবেই নজর কেড়েছে। শহরের এক প্রবীণ বাসিন্দার বক্তব্য, এই শিল্পীরা প্রতিমা গড়েন শিল্পের তাগিদ থেকে। তাই আর পাঁচ জন শিল্পীর থেকে পরেশবাবুর মতো শিল্পীদের কাজ অনেকটাই আলাদা।

কয়েক দশক আগে উত্তর কলকাতার এক পাড়ায় ঠাকুর গড়েছিলেন এক শিল্পী। সপ্তমীর কলাবৌ স্নানের পরেও মণ্ডপে গালে হাত দিয়ে বসে থাকতেন তিনি। তাঁর ইশারায় চালচিত্র বা অসুরের গায়ে একটু ‘টাচ’ দিয়ে আসতেন সহকারীরা।

পুজো ময়দানের খবর, এ বার নবীনদের এমন দাপটে কিছুটা হলেও নিষ্প্রভ এত দিনের প্রতিষ্ঠিত শিল্পীরা। তবে তাঁদের মধ্যে কিছুটা হলেও নজর কেড়েছেন সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় ও প্রশান্ত পাল। নিউ আলিপুর সুরুচি সঙ্ঘ ও উত্তরের সিকদারবাগানে ভিড় জমার পিছনে সুব্রতর কৃতিত্ব অনেকটাই। দমদম পার্ক তরুণ সঙ্ঘ, লালাবাগান নবাঙ্কুর, হিন্দুস্থান পার্ক সর্বজনীনে প্রশান্তর লালপেড়ে শাড়ি, শাঁখা-সিঁদুরের মণ্ডপ দেখার ভিড় সামলাতে নাকাল হয়েছে পুলিশ।

পুজোকর্তাদের অনেকেই বলছেন, থিমপুজোর গোড়া থেকে যে শিল্পীরা তারিফ কুড়িয়ে এসেছেন, তাঁদের কাজ কিছুটা একঘেয়ে হয়ে গিয়েছে। কেউ কেউ থিম গড়তে গিয়ে এত বেশি শিল্পের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় দৃষ্টিসুখটাকেই ঢাকা দিয়ে দেন। তার ফলেই লোকজন বা পুরস্কারদাতাদের কাছে জনপ্রিয়তা কমে গিয়েছে। উত্তরের এক পুজোকর্তার কথায়, “এক প্রতিষ্ঠিত শিল্পীর প্রতি বছর সব প্রতিমাই এক ধরনের হয়। ফলে নতুনত্ব মেলে না।”

এ বার অবশ্য বাজারে আর্থিক টানটাও নবীনদের উঠে আসার অন্যতম বড় কারণ। অর্থলগ্নি সংস্থার রমরমা বন্ধ হওয়ায় স্পনসর কমেছে। ফলে ইচ্ছে থাকলেও বহু ক্লাব বড় শিল্পীদের দিয়ে কাজ করাতে পারেননি। “এটা না হলে অনির্বাণ, মহেন্দ্র, পরিমলেরা কাজ দেখানোর হয়তো সুযোগই পেত না” বলছেন ওই কর্তা।

তবে শুধু এ বছর নয়। আগামী বছরেও যে পুজো বাজারে নবীনদের চাহিদা থাকবে, তা মালুম হয়েছে নবমীর রাত থেকেই। কেউ কেউ এ বারের শিল্পীকেই জনসমক্ষে বায়না করেছেন। কোথাও আবার তরুণ শিল্পী ক্লাব সদস্যদের সঙ্গেই অষ্টমীর রাতে ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছেন।

উত্তরে চমক দেখানো শিল্পীকে নিজের ক্লাবে নিয়ে যেতে ষষ্ঠীর রাত থেকেই মাঠে নেমেছেন পুজোকর্তাএমন ঘটনাও অবাস্তব নয়!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE