চলছে সিংহি পার্কের মণ্ডপ তৈরির কাজ। শনিবার। — দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
দু’দশক ধরে চলে আসা রীতিনীতির কি তবে পরিবর্তন ঘটতে চলেছে!
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সাবেকিয়ানা ছেড়ে কলকাতা ঝুঁকেছিল থিমে। এমনকী, সাবেকিয়ানাই ছিল যাদের ‘ইউএসপি’ তারাও থিমকে হাতিয়ার করে দর্শক টানছিল। কিন্তু সেই রীতি বোধহয় বদলাতে চলেছে। নতুন শিল্প হয়ে উঠে আসছে থিম ও সাবেকিয়ানার মিশেল।
সাবেকিয়ানাই ‘ইউএসপি’ ছিল সিংহি পার্কের পুজোর। সাবেক প্রতিমা, মণ্ডপ, চন্দননগরের আলোকে হাতিয়ার করে থিম পুজোর সঙ্গে ভিড় টানার লড়াইয়ে সমানে সমানে টেক্কা দিত তারা। গড়িয়াহাটের ভিড় সিংহি পার্কে ঢুকবে না, এমনটা কল্পনা করতে পারেন না পুলিশকর্তারাও। এ বার ৭৫ বছর পূর্তিতে সেই সিংহি পার্কেও কিছুটা বদলের ছোঁয়া! বলা যায়, অন্তরের সাবেকিয়ানা বজায় রেখে বহিরঙ্গে থিমের ছোঁয়া লাগছে সেখানে।
সিংহি পার্কে এ বার মণ্ডপ সেজে উঠছে গুজরাতের অম্বাজি মন্দিরের আদলে। প্রতিমার সাবেকিয়ানা একেবারে বদলাচ্ছে না বটে। কিন্তু বদলে যাচ্ছে অসুরের ভঙ্গি। পুজো কমিটির যুগ্ম সম্পাদক ভাস্কর নন্দী বলছেন, ‘‘যুদ্ধ নয়, শান্তি চাইয়ের বার্তা দিতে অসুর এ বার সমর্পণের ভঙ্গিতে থাকবে।’’ মণ্ডপের অন্দরেও থিম মিউজিকের তালে তালে বদলে যাবে আলোর কারিকুরি। বাইরে অবশ্য চেনা চন্দননগরের আলোই থাকবে সিংহি পার্কে। পুজো কমিটির প্রবীণ সদস্য বাপ্পা সেনের কথায়, ‘‘সিংহি পার্কের পুজোয় ঐতিহ্যই আসল। ৭৫ বছরে সেই ঐতিহ্যকেই তুলে ধরব আমরা।’’
একই ধাঁচে দিল্লির অক্ষরধাম মন্দিরের আদলে মণ্ডপ গড়ছে ৭৫ বছরের পুরনো গার্ডেনরিচের দেশগৌরব পাঠাগারের পুজো। আর মণ্ডপের অন্দরে থাকা এক চালার সাবেকি প্রতিমা রূপ পাচ্ছে শিল্পী সনাতন রুদ্র পালের হাতে। উত্তরের পুজো আর মেলা বলতেই এক কথায় উঠে আসে টালা সার্কাস ময়দানের পুজোর কথা। পোশাকি নাম বেলগাছিয়া সাধারণ দুর্গোৎসব। দীর্ঘ দিন ধরে সাবেকি পুজো করে আসা এই পুজোও নিজেকে বদলে ফেলেছে থিমে। এ বার শিল্পী সোমনাথ মুখোপাধ্যায় সেখানে গড়ে তুলছেন বাঘ সংরক্ষণের কথা। তবে এলাকাবাসীর আবেগের কথা ভেবে প্রতিমায় সাবেকিয়ানা থাকছে।
২০১১ ছিল রাজ্যে পরিবর্তনের বছর। ঘটনাচক্রে, সে বারই কলকাতার বহু সাবেকি পুজো সাবেকিয়ানা ছেড়ে পা বা়ড়িয়েছিল। তার মধ্যে অন্যতম ছিল উত্তর কলকাতার সব থেকে পুরনো পুজো বলে পরিচিত শ্যামপুকুর আদি সর্বজনীনও। এ বারও ঘুড়ি, লাটাই, পুতুল দিয়ে তৈরি মণ্ডপে বিমল মাইতি ও মধুময় মাইতি ‘ছোটবেলাকে ফিরে দেখা’-র থিম তুলে ধরছেন সেখানে। পুজোকর্তা শুভময় মল্লিকের বক্তব্য, ‘‘থিমের মণ্ডপ করলেও প্রতিমার সাবেকিয়ানায় হাত দিইনি আমরা।’’
গত কয়েক বছর ধরে থিমের বাজারে যেমন হুড়োহুড়ি পড়েছিল, সেই রীতিও যেন কিছুটা বদলে যাচ্ছে। থিমে হাত পাকিয়ে ফেলা বহু পুজোই ফিরে যাচ্ছে সাবেকিয়ানার আঙিনায়। সেই তালিকায় কালীঘাটের সঙ্ঘশ্রীর নাম উপরের দিকেই থাকবে। পুজো ময়দানের খবর, থিম থেকে সাবেকিয়ানায় ফিরে যাওয়ার পিছনে ভাঁড়ারে টানও একটা বড় কারণ। কারণ কম খরচে থিমের পুজো হয় বটে। কিন্তু তা লোক টানতে পারে না। সঙ্ঘশ্রীর এই ফিরে যাওয়া কিন্তু আখেরে লাভজনকও হতে পারে। এক সময়ে সাবেকি বিরাট মাপের প্রতিমাই ছিল সঙ্ঘশ্রীর ‘ইউএসপি’। এ বার সাবেকিয়ানায় ফিরে গিয়ে প্রতিমায় তেমনই চমক থাকছে। এক পুজোকর্তার মন্তব্য, ‘‘সিংহবাহিনী এখানে আক্ষরিক অর্থেই সিংহের পিঠে সওয়ার। প্রতিমার উচ্চতাও চমক জাগাবে।’’
পুজোকর্তারা মেনে নিচ্ছেন, থিমের বাহার এক সময় কলকাতাকে ছেয়ে ফেলেছিল বটে। কিন্তু ধীরে ধীরে এমন জটিল, কুটিল থিম শুরু হয়, প্রতিমার রূপ নিয়ে এতটাই পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করেন শিল্পীরা, যে দর্শকদের মনে তার একটি বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছিল। উত্তরের এক পুজোকর্তা বলছেন, ‘‘গত কয়েক বছর ধরে দর্শকেরা থিমের মণ্ডপ যেমন পছন্দ করছেন, তেমন প্রতিমার সাবেকি রূপই নজর কা়ড়ছে।’’ দক্ষিণের এক পুজো কমিটিও তাই প্রতিমায় থিমের বাহার পছন্দ করছে না। বছর দুয়েক আগে শহরের একটি পুজোয় নামী শিল্পীর গড়া প্রতিমার ভঙ্গিমা নিয়ে অনেকেই সমালোচনায় মুখর হয়েছিলেন। গড়িয়াহাটের কাছে একটি পুজো গত বছরের রেকর্ড ৎভিড় টেনেছিল। পুজো ময়দানের খবর, থিমের মণ্ডপের সঙ্গে আটপৌরে প্রতিমার মিশ্রণই তারিফ কু়ড়িয়েছিল দর্শকদের।
সাবেকিয়ানা বনাম থিমের লড়াই এত দিন ছিল। এ বার দুই ঘরানার মেলবন্ধন ল়়ড়াইয়ের রীতিটাও বদলে দেবে কি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy