Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

‘জেলাহীন’ দুপুরে স্টু-হীন প্লেট

সোমবার, কাজের দিনের দুপুরে সত্যিই অভাবনীয় সুনসান তল্লাট। দোকানের ঝাঁপ বন্ধ থাকায় শহরের অফিসপাড়ার বিখ্যাত চিকেন স্টুয়েরও দেখা নেই।

ঝাঁপ বন্ধ: ভোট দিতে ছুটি নিয়েছেন কর্মীরা। ডেকার্স লেন তাই কাজের দিনেও ফাঁকা। সোমবার। নিজস্ব চিত্র

ঝাঁপ বন্ধ: ভোট দিতে ছুটি নিয়েছেন কর্মীরা। ডেকার্স লেন তাই কাজের দিনেও ফাঁকা। সোমবার। নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ১৫ মে ২০১৮ ০১:৪৭
Share: Save:

শুধু বিদ্যাসাগর বা ক্ষুদিরামকে মনে রাখবেন?

মেদিনীপুর বলতে আর কিছু আপনাদের মনে পড়ে না?

ডেকার্স লেনের সর্বজনবিদিত ‘চিত্তদার ঠেকে’র উল্টো দিকের বেঞ্চিতে বসে সহাস্যে কথাটা বলছিলেন দাসপুরের ভূমিপুত্র জনৈক প্রদীপ কর। নিজেই জবাব দিলেন, ‘‘দেখছেন না, কলকাতার রাস্তায় রোল-চাউমিন-বিরিয়ানির বেশির ভাগ কারিগরই মেদিনীপুরের। পঞ্চায়েত ভোট এসে কলকাতার রাস্তা থেকে তাঁদের লোপাট করে দিল।’’

সোমবার, কাজের দিনের দুপুরে সত্যিই অভাবনীয় সুনসান তল্লাট। দোকানের ঝাঁপ বন্ধ থাকায় শহরের অফিসপাড়ার বিখ্যাত চিকেন স্টুয়েরও দেখা নেই। এ তল্লাটের নিত্যযাত্রী এবং ডেকার্স লেনের স্টুয়ের একনিষ্ঠ ভক্ত প্রদীপবাবু অগত্যা ব্যাজার মুখে পাশের দোকানের চাউমিন মুখে নিয়ে বসলেন।

পঞ্চায়েত ভোটের ধাক্কা অফিসপাড়ার নিত্যযাত্রীদের সংখ্যায়ও খানিক ছাপ ফেলেছে বটে! যেমন এসপ্লানেড ডাকঘরের কেন্দ্রীয় বাণিজ্য মন্ত্রকের বিস্ফোরক দফতরের দুই অফিসার ডেকার্স লেনে গুটিগুটি টিফিন করতে এসে বলে গেলেন, তাঁদের জনা চারেক সহকর্মী ‘দেশে’ ভোট দিতে গিয়েছেন। কিন্তু যাঁরা শহরে রয়েছেন, তাঁদের জন্য টিফিন করার জায়গার সংখ্যা কেজো দিনে এক ধাক্কায় কমে গুটি কয়েকে এসে দাঁড়িয়েছে। ডেকার্স লেন বা বিবাদী বাগ তল্লাটের চেহারাটা নিতান্তই ছুটির শহরের। রবিবার এ সব দোকান পুরোটা বন্ধ রাখাই দস্তুর। কাজের দিনের কলকাতায় শহরের ভিতরে ভোট না-থাকা সত্ত্বেও এতটা সুনসান ছবি— বড় একটা দেখা যায় না। কেষ্টপুর, সল্টলেক বা সেক্টর ফাইভের স্ট্রিট ফুড পসারিদের তল্লাটের ছবিটাও আদৌ স্বাভাবিক ‘কাজের দিনে’র মতো নয়। চিত্তদা অর্থাৎ, প্রয়াত চিত্তরঞ্জন রায়ের বড় ছেলে সমীরবাবু বলছিলেন, ‘‘আগে পঞ্চায়েত ভোট সাধারণত রবিবারে হত। তাই বোধহয় এ ভাবে পঞ্চায়েত ভোটের জন্য ছুটি দিতে হয়নি।’’ তাঁর মতে, কলকাতার স্ট্রিট ফুডের কারিগরদের মধ্যে মেদিনীপুর বা দক্ষিণ ২৪ পরগনাই দলে ভারী। বাঁকুড়ারও কয়েক জন থাকবেন।

শুধু ডেকার্স লেন নয়, পঞ্চায়েত ভোটের প্রভাব অন্যত্রও মালুম হয়েছে। ম্যাডান স্ট্রিটের ফুটপাতে আমতলার দুই ভাইয়ের পোড়খাওয়া ঘুগনির ঠেক বা মাছ-ভাতের পাইস হোটেল— সক্কলেই ঝাঁপ বন্ধ রেখেছে। প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিটের মুখেই একটি আনকোরা দোকানের কর্তা খদ্দেরদের বলছিলেন, ‘‘শুধু রোল-চাউমিন-রাইসে একটু চালিয়ে নিন। স্যান্ডউইচ বা মোগলাই পরোটা এখনই দিতে পারছি না।’’

কেন? দোকানের চার জন কর্মচারীর তিন জনই পটাশপুরের। এক জনকে রাজি করানো গিয়েছে, তিনি এ বার ভোট দিতে যাচ্ছেন না। ফলে, দোকান খোলা রাখা গিয়েছে। গণেশ অ্যাভিনিউয়ের দোকানের সরগরম ফুটপাতটাতেও শুধু টিমটিম করছেন চাট-কাঞ্জিবড়ার উত্তর ভারতীয় দোকানদার। ফুটপাতের বাকি সব ডালা ফাঁকা পড়ে। ডিম-টোস্ট, পনিরের তরকারি, চিকেন সুপ বা ভাত-মাছের পসারিরা কেউ চণ্ডীপুর, তাজপুর বা কাঁথিতে ভোট দিতে গিয়েছেন। ডেকার্স লেনের একটি নতুন রোল-চাউমিন ঠেকের তরুণ কর্তা সমীর ঘোষ কর্মচারীদের হাজির করাতে নাকের সামনে বোনাসের গাজরও ঝুলিয়েছেন। ভোটের দিন ডিউটিতে আসতে পারলেই বাড়তি হাজার টাকা! লাভ হয়নি। অগত্যা কম লোক নিয়েই খাবারের পদ কমিয়ে তাঁরা দোকান খোলা রেখেছেন। সমীর অবশ্য বলছেন, ‘‘গুটি কয়েক দোকান খোলা রাখায় ভিড়টা বেশিই হয়েছে। দুপুরের মধ্যে ১৫ কেজি চাউমিন খতম, অন্য দিন এতটা হয় না।’’

ডেকার্স লেনের আর এক দোকানেও সৌরভ হালদারেরা তিন ভাই মিলেই কর্মচারীদের অভাব পুষিয়ে দিচ্ছেন। তাঁদের এক কাকা নিরামিষ পোলাও আর ডিমের কষা বানিয়েছেন। সেটাই প্যাকেটে ভরে বা হাতে-গরম প্লেটে তুলে দেওয়া চলছে। কলকাতার রাজপথের রান্না কারিগরদের মধ্যে ভিন্‌ রাজ্যেরও কিছু লোক আছেন বটে। তবে শহরের পথের রসনা যে অনেকটাই পাড়াগাঁ-মফস্‌সলের রন্ধনশৈলীর দিকে তাকিয়ে, এই পঞ্চায়েত ভোট সেটাই বুঝিয়ে দিল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE