Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

রবির ছটায় ছক ভাঙছে তৃতীয় স্বর

সেই রূপান্তরকামী নারী শুভায়ু সেনগুপ্ত এ বার অন্য মঞ্চে গাইবেন। কুর্তা-লেগিংসের বদলে ইদানীং শাড়ি পরছেন শিল্পী।

ফাইল চিত্র।

ফাইল চিত্র।

ঋজু বসু
শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০১৮ ১২:৩২
Share: Save:

সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান তাঁর কণ্ঠে হুবহু শুনে অনেকেই মুগ্ধ হয়েছেন। কিন্তু আপাত পুরুষ অবয়বে, মেয়েলি স্বরের গানের জন্য ঠাট্টাও কম শুনতে হয়নি তাঁকে।

সেই রূপান্তরকামী নারী শুভায়ু সেনগুপ্ত এ বার অন্য মঞ্চে গাইবেন। কুর্তা-লেগিংসের বদলে ইদানীং শাড়ি পরছেন শিল্পী। বুধবার পঁচিশে বৈশাখ যৌন সংখ্যালঘু প্রান্তিক মেয়ে-পুরুষের এক অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র জয়ন্তীর আসরে তিনি সামিল হবেন।

ছোট থেকে বেতারে অনুষ্ঠান, আবৃত্তি, সঞ্চালনায় সড়গড় তিস্তা দাসের জন্মদিনও পঁচিশে বৈশাখ। যথাযথ নারী নন তকমা দিয়ে সমাজের নানা অপমান সইবার গ্লানিতে এখনও বলাকা-র রবীন্দ্র-কবিতা থেকেই অক্সিজেন সংগ্রহ করেন তিনি। ইউ টিউবের রূপান্তরকামী নারী সঞ্চালক অনুরাগ মৈত্রীর সঙ্গে বসে তিস্তা রবীন্দ্রনাথের ‘হোরিখেলা’ পাঠের অংশ ভাগ করে নিচ্ছেন। পঁচিশে বৈশাখের সন্ধ্যায় হাঙ্গারফোর্ড স্ট্রিটের প্রেক্ষাগৃহে এক সঙ্গে কবিতা পড়ার বোঝাপড়া ঝালিয়ে নিতে ব্যস্ত তাঁরা।

অভিনয়, নাচ, গান, মডেলিংয়ে রূপান্তরকামী মেয়ে-পুরুষরা অনেকেই ইদানীং বাধা ঠেলে সামনে আসছেন। মূল স্রোতের সঙ্গে মিশেই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মেলে ধরছেন সৃষ্টিশীল প্রতিভা। কিন্তু বঞ্চনা বা বৈষম্যের টনটনে ব্যথার জায়গাটাও রয়েছে। রাজ্যে ‘ট্রান্সজেন্ডার ডেভলপমেন্ট বোর্ড’-এর সদস্য তথা রূপান্তরকামীদের অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে সামিল সমাজকর্মী রঞ্জিতা সিংহ জানান, পড়শি রাজ্য বিহার দু’-তিন বছর ধরে সারা দেশের রূপান্তরকামীদের নিয়ে ‘কিন্নর উৎসব’ করছে। এর পাশে বাংলায় রূপান্তরকামী শিল্পীদের স্বীকৃতিতে অঢেল ফাঁক। রাজ্যের নারী, শিশু ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রী তথা ট্রান্সজেন্ডার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের চেয়ারপার্সন শশী পাঁজার কথায়, ‘‘প্রস্তাব পেলে বিষয়টি নিয়ে ভাবা যেতে পারে।’’ আর রঞ্জিতারা বলছেন, রাজ্যকে বার বার বললেও রূপান্তরকামীদের স্বীকৃতি মেলেনি। তাই একটা বার্তা দিতেই রূপান্তরকামী সমাজের একাংশ মিলে পঁচিশে বৈশাখ উদ্‌যাপনের আলাদা মঞ্চে জড়ো হচ্ছেন।

শহরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে স্বাস্থ্যকর্মীর তালিম নিতে ব্যস্ত দেবদত্তা বিশ্বাস ঠিক করেছেন, চিত্রাঙ্গদা-র কুরূপা থেকে সুরূপায় রূপান্তরের অংশটি মঞ্চে উপস্থাপনা করবেন। ‘আমি নহি রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদা, আমি শুধু এক রাত্রে ফোটা অরণ্যের পিতৃমাতৃহীন ফুল তার পরে ধূলিসজ্জা, তার পরে ধরণীর চির অবহেলা’! এর পরে গাইবেন, ‘আমার অঙ্গে অঙ্গে কে বাজায় বাঁশি’! আর সুন্দরবন লাগোয়া সরবেড়িয়া থেকে কত্থক-ভরতনাট্যমে নিজেকে মেলে ধরার স্বপ্ন দেখা রূপান্তরকামী অনুরাধা সরকার ঠিক করেছেন, ‘বাসন্তী হে ভুবনমোহিনী’-র সঙ্গে ধ্রুপদী নাচে মাতবেন। রূপান্তরকামী নারীদের ক্ষেত্রে যথেষ্ট নারীসুলভ নন বলে যেমন খোঁচা শুনতে হয়, তেমনই রূপান্তরকামী পুরুষদেরও পুরুষ বলে মানতে চান না

অনেকে। ম্যানেজমেন্টের ছাত্র, পেশায় নিজস্ব ইভেন্ট সংস্থার কর্তা কেতকী থেকে কবিরাগ পোদ্দার হয়েছেন কিছু দিন হল। রবীন্দ্র-জয়ন্তীতে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুচেতনায় প্রাণিত স্বরচিত কবিতা শোনানোর ইচ্ছে কবিরাগের। আইনজীবী অঙ্কন বিশ্বাস বা সরকারি কর্মচারী জো-ও এই আসরে শিল্পী।

হোয়াটসঅ্যাপে চাউর করা আমন্ত্রণপত্রে লেখা, ‘উচ্চ যেথা শির’! অনুষ্ঠানের শিল্পীদের মধ্যেও ঘা-খাওয়া স্বর মেলে ধরার তাগিদ। রবীন্দ্রসৃষ্টির আলো মেখেই পুরুষ-নারীর ছকে বাঁধা অস্তিত্ব খান খান করে দিতে বদ্ধপরিকর এই তৃতীয় স্বর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE