নজরে মঙ্গল। বুধবার, বিআইটিএম-এ টেলিস্কোপে চোখ স্কুলপড়ুয়াদের। ছবি: দেবাশিস রায়।
কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গিয়েছিল সোমবারই। লাল গ্রহের একেবারে কাছে চলে এসেছে ইসরো-র মঙ্গলযান। কী হয়! কী হয়! যদি শেষ ধাপে বিগড়ে যায় কোনও একটা যন্ত্র। নানা আশঙ্কা দানা বাঁধছিল বিজ্ঞানীদের মনে। যদি মঙ্গলযানকে লাল গ্রহের কক্ষপথে পাঠাতে ব্যর্থ হয় ভারত। শুধু ইসরোই নয়, শেষ ক’টা দিন উৎকণ্ঠায় ছিলেন কলকাতার বিজ্ঞানীরাও। সকাল ৭টা বেজে ৫৮ মিনিট নাগাদ লালগ্রহের কক্ষপথে মঙ্গলযানের পৌঁছে যাওয়ার খবরটা আসতেই, তাই উল্লাসে লাফিয়ে উঠলেন তাঁরাও।
সকাল থেকে খুব উৎকণ্ঠার মধ্যে কাটিয়েছেন বিআইটিএম-এর মুখপাত্র গৌতম শীল। জানতেনই টেনশন কাজ করবে। তাই চাকদহের স্কুল থেকে অনুরোধ জানাতেই রাজি হয়ে যান তিনি। তিনটি স্কুল নিয়ে বিআইটিএমএ-তে আয়োজন করেন একটি অনুষ্ঠানের। বিষয় ছিল মূলত মঙ্গল-দর্শন। ছোটদের শেখানো হয় মঙ্গলের গতি-প্রকৃতি।
চাকদহের ওই স্কুলের পড়ুয়ারা কোনও দিন টেলিস্কোপ দেখেনি। যন্ত্রটা দেখেই অবাক তারা। গৌতমবাবু বললেন, “কপালটা মন্দ। আকাশ মেঘলা ছিল। বাচ্চাগুলোকে তাই মঙ্গল দেখানো যায়নি।” জানালেন, ইসরো-র এমন একটা সাফল্যও খুদেদের বোঝানোর চেষ্টাও করেছেন তিনি। “এ দেশের বিজ্ঞানীরা যে চাইলে অনেক কিছু পারেন, সেটাই আজ দেখিয়ে দিয়েছে ইসরো। আর খরচ? দেশের জনসংখ্যার হিসেবে মাথাপিছু মাত্র ৪ টাকা করে পড়েছে। ভাবা যায়! এ বাজারে চার টাকায় কী হয়!” বললেন গৌতমবাবু।
একই বক্তব্য ৮৪ বছর বয়সী প্রবীণ জ্যোতির্বিজ্ঞানী অমলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের। সংবাদমাধ্যমের ফোন পেয়েই উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েন তিনি। বললেন, “কী গর্ব যে হচ্ছে! প্রথম সুযোগেই কী কেরামতি দেখালেন ভারতের বিজ্ঞানীরা!” তবে বারবারই তিনি বললেন নেতামন্ত্রীদের কথা। অমলেন্দুবাবুর মতে, সরকার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে না দিলে সিদ্ধিলাভ অসম্ভব ছিল।
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার বিভাগীয় প্রধান সোমক রায়চৌধুরীও অমলেন্দুবাবুর সঙ্গে সহমত। তাঁর বক্তব্য, “কত প্রকল্প সরকারি সাহায্যের অভাবে আটকে যায়। নয়াদিল্লি যদি ওই ভাবে পাশে এসে না দাঁড়াত, তবে কি ইসরো-র পক্ষে সম্ভব হতো এই সাফল্য চেখে দেখার?”
তবে সস্তায় সফল অভিযান, কিংবা প্রথম চেষ্টাতেই জয়— এ সবের থেকেও সোমকবাবু বড় করে দেখছেন ভারতীয় বিজ্ঞানীদের হাত ধরে প্রযুক্তির উন্নতি। বললেন, “কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে ভারতীয় প্রযুক্তি, এক বার ভেবে দেখুন!” তাঁর কথায়, “আজ মঙ্গলযানের জন্য গোটা বিশ্বের নজরে ইসরো। কিন্তু সেই কবে থেকেই তো বিভিন্ন দেশকে আবহাওয়ার রিপোর্ট পাঠাচ্ছে তারা।”
সাহা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী সুকল্যাণ চট্টোপাধ্যায়ও বলেন, “প্রযুক্তিগত ভাবে ভারত যে কতটা এগিয়ে গিয়েছে, সেটাই কিন্তু প্রমাণ হল আজ। আমেরিকায় নাসা যে ভূমিকা পালন করে, আশা করি আগামী ন’-দশ বছরের মধ্যে ইসরো সেটাই করে দেখাবে ভারতে। নিজেরাই দেশে আরও নতুন নতুন প্রযুক্তি আনবে।” তিনি আরও বলেন, “অনেকেই প্রশ্ন তুলছে, আমাদের মতো গরিব দেশে এ ভাবে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা কি ঠিক? এ প্রসঙ্গে বলা ভাল, একটা টাকাও কিন্তু নষ্ট হচ্ছে না। ভবিষ্যতই তা জানিয়ে দেবে।” শুধু তা-ই নয়, দেশে থেকে গবেষণা করার বিষয়ে আরও উৎসাহ পাবেন ছেলেমেয়েরা। বললেন, “আমাদের বাঙালি বিজ্ঞানী বেদব্রত পাইন তো নাসায় কাজ করছেন। ইসরোর সাফল্যে পর দেশেই পড়াশোনা করার স্বপ্ন দেখবে ছেলেমেয়েরা। সে সঙ্গে আত্মবিশ্বাসও বাড়বে।”
প্রযুক্তিগত সাফল্যকেই বড় করে দেখছেন অমলেন্দুবাবুও। জানালেন, সকাল ৭টা ১৮ মিনিটে মঙ্গলযানের লিকুইড অ্যাপোজি মোটর (ল্যাম) চালু করা হয়েছিল। তার পরে পরিকল্পনা মতো যানের নিয়ন্ত্রণ ল্যাম-এর হাতে ছেড়ে দেয় ইসরো। মঙ্গলযান যাতে লাল গ্রহের আকর্ষণে মাটিতে আছড়ে না পড়ে এবং অতিরিক্ত গতিতে ছিটকে বেরিয়ে না যায়, তা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব ছিল ল্যামের। এ দিন সকালে মঙ্গলযানের গতি ছিল সেকেন্ডে প্রায় ৫ কিলোমিটার। ল্যামের সাহায্যে তা ৪.৩ কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ডে নামিয়ে আনা হয়। ৭টা ৫৮ নাগাদ ইসরো জানায়, অভিযান সফল। প্রবীণ বিজ্ঞানী বললেন, “সময়ের কী মাপজোক দেখুন! একটু এ ধার-ও ধার হলেই কিন্তু সব শেষ হয়ে যেত। ওই ২৪ মিনিট যে কী ভাবে সামলেছে ইসরো, কুর্নিশ জানাতেই হয়।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy