Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

দশ দিন পরে একটু ছোট টাকার লাইন

আগে পাঁচশো গ্রাম মাছ কিনতেন, এখন কিনছেন মাত্র আড়াইশো। বিকেলের ফুচকা খাওয়ার অভ্যাসটাও বাদ দিয়ে দিয়েছেন বাগবাজারের রত্না চট্টোপাধ্যায়।

লাইন আছে, তবে কমেছে দৈর্ঘ্য। শুক্রবার, বি বা দী বাগে। — স্বাতী চক্রবর্তী

লাইন আছে, তবে কমেছে দৈর্ঘ্য। শুক্রবার, বি বা দী বাগে। — স্বাতী চক্রবর্তী

তানিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০১৬ ০১:০২
Share: Save:

আগে পাঁচশো গ্রাম মাছ কিনতেন, এখন কিনছেন মাত্র আড়াইশো। বিকেলের ফুচকা খাওয়ার অভ্যাসটাও বাদ দিয়ে দিয়েছেন বাগবাজারের রত্না চট্টোপাধ্যায়।

বালিগঞ্জের রিমি সেনও সন্ধ্যায় বেড়াতে বেরিয়ে কেনাকাটার লিস্টটা কমিয়ে ফেলেছেন।

নোট যে বড় অমূল্য!

কিন্তু গড়িয়াহাটের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের এটিএমের সামনে শুক্রবার সকাল সাড়ে দশটায় সেই অমূল্য ধনের সন্ধানে তেমন লাইন নেই। জনা দশেক লোক দাঁড়িয়ে। বৃহস্পতিবার ছিল ২০-২৫ জন। কিন্তু বুধবার রাত পর্যন্তও শ’খানেক লোক দাঁড়িয়ে থাকতেন। হঠাৎ কমে গেল কী করে?

শুধু গড়িয়াহাট নয়। বালিগঞ্জ থেকে হাতিবাগান— এটিএমের সামনের লাইনটা যেন পাতলা হয়ে গিয়েছে। দু’দিন আগের ভিড়ে থিকথিক ব্যাঙ্ক চত্বরেও এ দিন তুলনায় লোক কম। তবে কি ব্যাঙ্কের হাতে পর্যাপ্ত টাকা চলে এসেছে, সহজেই লেনদেন হয়ে যাচ্ছে? নাকি আমজনতার টাকার প্রয়োজনটাই ফুরিয়ে গিয়েছে?

শহরের বিভিন্ন ব্যাঙ্ক ঘুরে জানা গেল— আমজনতা অমূল্য ধনের মূল্য টের পেয়েছেন। ব্যাঙ্কের সামনে যাঁরা অপেক্ষা করছেন, তাঁরা জানাচ্ছেন— কম খরচেও যে সংসার চালানো যায়, তা শিখিয়ে দিল নোট বাতিলের নির্দেশ। ব্যাঙ্ক, এটিএমের সামনে লম্বা লাইনে ঘণ্টা পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে যৎসামান্য টাকা হাতে পাচ্ছেন গ্রাহকেরা। ফের টাকা তোলার ভোগান্তির ভয়েই কম খরচ করছে আমজনতা।

তবে ব্যাঙ্ক কর্তারা জানাচ্ছেন, এক দিকে টাকা বদলে কালি দেওয়া, অন্য দিকে আমজনতার কম খরচ— দুই মিলিয়ে হাঁফ নেওয়ার সময় পাচ্ছেন ব্যাঙ্ককর্মীরা। চাপ অনেকটাই কমেছে বলে মনে করছেন ব্যাঙ্ক-কর্তারা। উত্তর থেকে দক্ষিণ, শহরের বিভিন্ন শাখার সামনে লাইন তেমন নেই। টাকা জমা দেওয়া ও তোলার লাইন থাকলেও টাকা বদলের লাইন প্রায় নেই বললেই চলে। কালির দাওয়াইয়েই বদলের লাইন পাতলা হয়ে গিয়েছে বলে মনে করছেন ব্যাঙ্কের কর্মীরা। কয়েকটি জায়গা ছাড়া গত সপ্তাহের চেনা ছবিটা আর চোখে পড়ল না।

ভোটার কার্ড, আধার কার্ডের মতো পরিচয়পত্র থাকলেই যে কোনও ব্যাঙ্কে গিয়ে বাতিল ৫০০, ১০০০ টাকার নোট বদল করা যাচ্ছিল। এই টাকা বদল করতে হিমশিম খাচ্ছিলেন ব্যাঙ্ককর্মীরা। হাতিবাগানের এক বহুতলের দোতলায় একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের শাখায় দু’দিন আগেও টাকা বদলের লাইন চলে নেমে যেত রাস্তা পর্যন্ত। এ দিন সেই ছবি নেই। টাকা জমা দেওয়া ও তোলার ভিড়টা একই আছে। তবে তা সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে অসুবিধা হচ্ছে না বলেই জানালেন ওই শাখার ম্যানেজার।

এ দিন ব্যাঙ্কে টাকা জমা দেওয়ার লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন কলেজ পড়ুয়া সম্প্রীতি রায়। জানালেন, টাকা জমা দিতে এলেও এক সপ্তাহের আগে টাকা তুলবেন না। সম্প্রীতির কথায়, ‘‘বাবা টাকা জমা দিতে পাঠিয়েছে। বাধ্য হয়েই এসেছি। কিন্তু এক সপ্তাহের আগে আর এটিএমের ধারেকাছে যাচ্ছি না। ঘণ্টাখানেক দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল! যা পেয়েছি, এখন তা দিয়েই চালিয়ে দেব।’’

আর একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কের গিরিশ পার্ক শাখার ছবিটাও এক। নোট বদলের লাইন প্রায় নেই। বৃহস্পতিবার বিকেল থেকেই যে নোট বদলের লোক কমছে, তা বুঝতে পারছিলেন ব্যাঙ্ক কর্মীরা। সকালে কিছুটা ভিড় থাকলেও দুপুরের পর থেকে শুধু টাকা জমা আর তোলা হয়েছে বলেই জানান ওই শাখার কর্মীরা। লম্বা লাইনটা কর্পূরের মতো উবে যাওয়ায় অবাক গ্রাহকেরাও। এ দিন ওই শাখায় টাকা বদল করতে এসেছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা আশি বছরের স্নিগ্ধা সরকার। তাঁর কথায়, ‘‘সপ্তাহখানেক ধরে যা লাইন দেখছিলাম, ব্যাঙ্কে আসার সাহস পাইনি। কাল নাতনি বলছিল টাকা বদলের লাইনটা একটু ছোট হয়েছে। তাই আজ ওর সঙ্গে ব্যাঙ্কে এসেছি। আজ তো টাকা বদলের লাইন নেই। এত কম সময়ে তিনটে পাঁচশোর নোট বদলাতে পারব, ভাবতেই পারিনি।’’

বাগবাজারে এক বেসরকারি ব্যাঙ্কের শাখায় টাকা তুলতে এসে জয়া সাহা বললেন, ‘‘ব্যাঙ্কে আসতেই ভয় পাচ্ছি। যা ভিড়। তবে আজ তো দেখছি, তেমন কিছু নেই। ব্যাঙ্ক বা এটিএমের সামনে যাতে লাইন দিতে না হয়, তার জন্য খুব হিসেব করে জিনিস কিনছি। দরকার ছাড়া এখন কোনও খরচ নয়।’’

একই ছবি দেখা গেল তেঘরিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কেও। দিন কয়েক আগে পা দেওয়ার জায়গা মিলছিল না ওই শাখায়। লেনদেনকারীদের জন্য ব্যাঙ্কের বাইরে চেয়ারে বসার ব্যবস্থাও করেছিল কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। এ দিন সেই চেয়ার থাকলেও বসার লোক বিশেষ ছিল না।

উত্তরের মতো দক্ষিণেও ছবিটা একই। গড়িয়াহাট, বালিগঞ্জ, যোধপুর পার্ক, যাদবপুরে বিভিন্ন ব্যাঙ্কের শাখায় টাকা বদলের লাইন এ দিন ছিল না বললেই চলে। তবে এ দিনও বেশ কিছু শাখায় পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় লেনদেনে সমস্যা হয়। টাকা তুলতে গিয়ে দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়ান অনেকেই। অফিস যাওয়ার আগে একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কের স্টিফেন হাউস শাখায় টাকা তোলার লাইনে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন এক বেসরকারি সংস্থার কর্তা। কিন্তু চেকে যে পরিমাণ টাকা তোলার জন্য যত সংখ্যক লোক লাইনে ছিলেন, ব্যাঙ্কে ততটা টাকা ছিল না। অগত্যা টাকা না তুলেই অফিসে ফিরে যান তিনি। আর একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের হাতিবাগান শাখায় টাকা শেষ হয়ে যাওয়ায় সাময়িক ভাবে লেনদেন বন্ধ হয়ে যায়। গোয়াবাগানের বাসিন্দা বাহাত্তর বছরের অমিত সেনগুপ্ত গত দু’দিনের মতো এ দিনও টাকা তুলতে গিয়ে ফিরে এসেছেন। নিজের সমস্যার কথা জানাতে বারবার ফোন করেছেন ব্যাঙ্কের হেল্প লাইনে। কিন্তু সেখানেও কেউ ফোন ধরেননি। অমিতবাবু বলেন, ‘‘এই বয়সে এত হেনস্থা নিতে পারছি না। স্ত্রীর হার্টের সমস্যায় ভুগছেন। ডাক্তার দেখাতে হবে, সংসার চালাতে হবে। কিন্তু হাতে নগদ টাকা নেই। কী ভাবে সব সামলাব, বুঝতে পারছি না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

ATM Queue Demonetization
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE