মুমূর্ষু রোগীকে ন্যূনতম চিকিৎসা না দিয়ে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। হাসপাতালে গিয়ে ট্রলি পাচ্ছেন না রোগী। স্ট্রেচারের অভাবে মুমূর্ষুকে পাঁজাকোলা করে পরিজনেরা ছুটছেন এক ওয়ার্ড থেকে অন্য ওয়ার্ডে। ভিড়ে ঠাসা বিভাগে শয্যা পেতে দালালদের হাতে দিতে হচ্ছে মোটা টাকা। সময়ে হাসপাতালে আসছেন না চিকিৎসকেরা। নার্সেরা নিজেদের কাজ করাচ্ছেন আয়াদের দিয়ে। ইসিজি-এক্স রে করছেন চতুর্থ শ্রেণির কর্মী।
সরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলি থেকে এমন অভিযোগ পেয়ে পেয়ে তিতিবিরক্ত খোদ মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সুপার-অধ্যক্ষদের কাছে তাঁর প্রশ্ন, ‘‘আপনারা যখন যা চাইছেন, তা দিয়ে দেওয়ার পরেও এমন অভিযোগ শুনতে হবে কেন? কেন মেডিক্যাল কলেজগুলির মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গাতেও কোনও নজরদারি থাকবে না? কেন যা খুশি তাই করেও অনেকেই পার পেয়ে যাবেন?’’
মুখ্যমন্ত্রীর এই প্রশ্নে রীতিমতো থরহরি অবস্থা রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তাদের। গ্রামীণ বা মহকুমা হাসপাতাল নয়, মেডিক্যাল কলেজ, অর্থাৎ যেখানে সবচেয়ে উচ্চমানের চিকিৎসা পাওয়ার কথা, সেখানেই যদি এই হাল হয় তা হলে স্বাস্থ্যের হাল ফেরানোর যাবতীয় দাবিই তো জলে যাবে! তাই মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে এ বার তড়িঘড়ি মেডিক্যাল কলেজগুলির জন্য ভিজিল্যান্স কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হল।
ওই কমিটি আচমকা পরিদর্শন করে হাসপাতালের হাল খতিয়ে দেখবে। দেখবে রোগী পরিষেবার সঠিক ছবিটা। সেই অনুযায়ী রিপোর্ট তৈরি করবে তারা। পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে সেই রিপোর্ট পৌঁছে যাবে এমনকী মুখ্যমন্ত্রীর টেবিলেও। আর কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করবে স্বাস্থ্য দফতর। প্রাথমিক ভাবে প্রত্যেকটি কলেজের অধ্যক্ষদের উপরে নজরদারির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেখানেই শেষ নয়। পরবর্তী স্তরে বাইরের একটি কমিটিও নজর রাখবে কলেজগুলির উপরে। নিয়মিত খোঁজখবর ও আচমকা হাসপাতাল পরিদর্শনও করবেন কমিটির সদস্যেরা। রাজ্যের স্বাস্থ্য সচিব, স্বাস্থ্য (শিক্ষা) অধিকর্তা, বিশেষ সচিব-সহ একাধিক শীর্ষ কর্তাকে রাখা হয়েছে ওই ভিজিল্যান্স কমিটিতে। রোগী কল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান এবং স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী শশী পাঁজাকেও আচমকা মেডিক্যাল কলেজ পরিদর্শনে যেতে বলা হয়েছে।
২০১১-এ ক্ষমতায় আসার পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বাস্থ্যকে তাঁর অগ্রাধিকারের তালিকায় রেখেছিলেন। মহাকরণে যাওয়ার আগে নিজে আচমকা হাসপাতালে হাজির হওয়া থেকে শুরু করে পরিষেবা ক্ষেত্রে বেশ কিছু বদলও এনেছিলেন তিনি। কিন্তু তার পরেও স্বাস্থ্য সম্পর্কে সাধারণ মানুষের অভিযোগের জায়গাটা বদলায়নি। নবান্ন সূত্রে খবর, দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে তাই স্বাস্থ্য নিয়ে ঝুঁকি নিতে চাইছেন না মমতা। তাই সরকার গঠনের পরে শুরু থেকেই স্বাস্থ্য পরিষেবাকে শৃঙ্খলায় বাঁধতে চলেছেন তিনি। তবে তা কতটা বাস্তবায়িত হবে, তা নির্ভর করছে তাঁর দফতরের কর্তাদের তৎপরতার উপরেই। সম্প্রতি নবান্নে বিভিন্ন হাসপাতালের সুপার ও অধ্যক্ষদের বৈঠকে ডেকে আরও এক বার সেই বার্তাই দিতে চেয়েছেন তিনি।
দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘‘লাগাতার নজরদারির জন্য লোকাভাব বড় সমস্যা। শুধু তা-ই নয়, স্থানীয় স্তরে প্রশাসনকে মানতে চান না অনেকেই। বহু সিনিয়র ডাক্তার-নার্সই সুপার বা অধ্যক্ষদের তেমন গুরুত্ব দেন না। বিভাগীয় প্রধানরাও হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষের কথা মানতে চান না। ফলে শৃঙ্খলা রক্ষা করা বহু সময়েই সমস্যা হয়ে যায়। উচ্চ পর্যায়ের ভিজিল্যান্স কমিটি থাকলে ছবিটা হয়তো বদলাবে।’’
নবান্নের বৈঠকে উপস্থিত কলকাতার এক মেডিক্যাল কলেজের সুপার জানান, নজরদারির অভাবের প্রসঙ্গে এক স্বাস্থ্যকর্তা মেডিক্যাল কলেজের মেডিক্যাল সুপার কাম ভাইস প্রিন্সিপাল (এমএসভিপি) পদ ভেঙে দু’জন আলাদা ব্যক্তির উপরে তা রাখার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তাঁর প্রস্তাব ছিল, পাবলিক হেল্থ অ্যান্ড অ্যাডমনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস থেকে সুপার এবং মেডিক্যাল এডুকেশন বিভাগ থেকে যদি ভাইস প্রিন্সিপাল নিয়োগ করা হয়, তা হলে দায়িত্বের ভাগবাঁটোয়ারা হবে, আর নজরদারি আরও আঁটোসাঁটো করা যাবে। কিন্তু ‘অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্টের’ কথা ভেবে মুখ্যমন্ত্রী সেই প্রস্তাবে রাজি হননি। তাঁর মনে হয়েছে, এর ফলে মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষের মধ্যে দায় এড়ানোর প্রবণতা আরও বাড়বে। স্বাস্থ্য (শিক্ষা) অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপরেই যাবতীয় দায়িত্ব রেখেছেন তিনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy