Advertisement
E-Paper

দেবযানী রহস্য বাড়ল উইলের খবরে

মেয়ে যদি মারা গিয়ে থাকেন, তা হলে বাবা তার নামে উইল করবেন কেন। আপাত দৃষ্টিতে সরল এই প্রশ্নটার মধ্যেই রবিনসন স্ট্রিটের কঙ্কাল কাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ সূত্র লুকিয়ে রয়েছে বলে মনে করছে পুলিশ। পার্থ-দেবযানীর বাবা অরবিন্দ দে যে আত্মহত্যাই করেছেন, সে ব্যাপারে অবশ্য তদন্তকারীরা প্রায় নিশ্চিত। বুধবার রাতে রবিনসন স্ট্রিটের ফ্ল্যাটের শৌচাগার থেকে অরবিন্দবাবুর দগ্ধ দেহ উদ্ধার করেছিল পুলিশ। ময়না তদন্ত রিপোর্টে খুনের কোনও প্রমাণ মেলেনি।

কুন্তক চট্টোপাধ্যায় ও শুভাশিস ঘটক

শেষ আপডেট: ১৩ জুন ২০১৫ ০৩:১৮
রবিনসন স্ট্রিটের সেই বাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া কঙ্কাল। — নিজস্ব চিত্র।

রবিনসন স্ট্রিটের সেই বাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া কঙ্কাল। — নিজস্ব চিত্র।

মেয়ে যদি মারা গিয়ে থাকেন, তা হলে বাবা তার নামে উইল করবেন কেন। আপাত দৃষ্টিতে সরল এই প্রশ্নটার মধ্যেই রবিনসন স্ট্রিটের কঙ্কাল কাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ সূত্র লুকিয়ে রয়েছে বলে মনে করছে পুলিশ।

পার্থ-দেবযানীর বাবা অরবিন্দ দে যে আত্মহত্যাই করেছেন, সে ব্যাপারে অবশ্য তদন্তকারীরা প্রায় নিশ্চিত। বুধবার রাতে রবিনসন স্ট্রিটের ফ্ল্যাটের শৌচাগার থেকে অরবিন্দবাবুর দগ্ধ দেহ উদ্ধার করেছিল পুলিশ। ময়না তদন্ত রিপোর্টে খুনের কোনও প্রমাণ মেলেনি। কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দাপ্রধান পল্লবকান্তি ঘোষ শুক্রবার বলেন, ‘‘অরবিন্দবাবু আত্মহত্যাই করেছেন।’’ ইতিমধ্যে পুলিশ ওই ফ্ল্যাট থেকে অরবিন্দবাবুর লেখা সুইসাইড নোটও পেয়েছে। ৮ জুন ওই নোট লিখেছিলেন বৃদ্ধ। তদন্তে নেমে পুলিশ এখন জানতে পারছে, ওই দিনই তিনি সম্পত্তি উইল করার ব্যাপারে কথা বলতে হাইকোর্ট পাড়াতেও গিয়েছিলেন। সংশ্লিষ্ট আইনজীবী পুলিশকে জানিয়েছেন, অরবিন্দবাবু উইলে তাঁর ছেলে ও মেয়ে, অর্থাৎ পার্থ ও দেবযানী, দু’জনের নামই রাখতে চেয়েছিলেন।

এই তথ্যটি নতুন করে ধন্দে ফেলেছে পুলিশকে। পার্থবাবুর বয়ান অনুযায়ী, দেবযানী ছ’মাস আগেই মারা গিয়েছেন। তাঁর কঙ্কালই ঘরের মধ্যে রেখে দিয়েছিলেন পার্থ। তা-ই যদি হয়, তা হলে মৃত মেয়ের নাম উইলে রাখতে চাইছিলেন কেন অরবিন্দবাবু? তবে কি ছেলের মতো তিনিও কোনও অলীক বিশ্বাসে ভর দিয়ে বাঁচছিলেন? নাকি দেবযানীর মৃত্যুকে সকলের চোখের আড়ালে রাখতেই তাঁর এই কৌশলগত পদক্ষেপ? নাকি এমনও হতে পারে যে, দেবযানী আদতে জীবিত?

রবিনসন স্ট্রিটের সেই বাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া কঙ্কাল। — নিজস্ব চিত্র।

অরবিন্দবাবুর ভাইয়ের পরিবার সূত্রে আগেই জানানো হয়েছিল যে, গত মাসে পার্থবাবুর জন্মদিনের দিন যখন তাঁরা ওই ফ্ল্যাটে যান, তখন দেবযানীর কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন তাঁরা। উত্তরে অরবিন্দবাবু জানিয়েছিলেন, দেবযানী একটি হোমে আছেন। ভাল আছেন। পুলিশের বক্তব্য, এ কথা যদি সত্য হয়, তবে দেবযানী কোথায় আছেন, সেটা জানা দরকার। সে ক্ষেত্রে ঘরে পাওয়া নরকঙ্কালটি কার, সে প্রশ্নও আলাদা করে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। আর অরবিন্দবাবু যদি মিথ্যে কথা বলে থাকেন, তা হলে প্রশ্ন রয়ে যায়, অরবিন্দবাবু কি শুধু কঙ্কালটি আড়াল করতে চাইছিলেন? নাকি তার পিছনে চাপা পড়ে থাকা আরও কোনও অপরাধ গোপন রাখাও তাঁর উদ্দেশ্য ছিল?

প্রশ্নগুলির চটজলদি উত্তর পাওয়া সহজ নয়। নরকঙ্কালের ময়না তদন্তে এ দিন আঘাতের কোনও চিহ্ন মেলেনি। তবে হাড়ে আঘাতের চিহ্ন না থাকলেই যে মৃত্যু স্বাভাবিক, তা অবশ্য নিশ্চিত করে বলা যায় না। পুলিশ সূত্রের খবর, কাউকে যদি বালিশ চাপা দিয়ে শ্বাসরোধ করে মারা হয় কিংবা বিষ প্রয়োগ করা হয়, তা হলে কঙ্কালের ময়নাতদন্ত করে তার প্রমাণ পাওয়া সম্ভব নয়। পার্থ তাঁর বয়ানে জানিয়েছিলেন, দেবযানী উপবাসে মারা গিয়েছিলেন। সেটিরও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, অনাহারে থাকলে পিত্তথলি দেখে সেটা বোঝা যায়। কঙ্কালের ক্ষেত্রে সেই পরীক্ষা করা যায়নি। লালবাজার জানিয়েছে, দ্বিতীয় দফায় ওই কঙ্কালের রেডিওলজি ও হাড়ের বয়স নির্ধারণের পরীক্ষা করা হবে। আর ডিএনএ পরীক্ষা করলে বোঝা যাবে, ওটি দেবযানীরই কঙ্কাল কি না। কুকুরের কঙ্কাল দু’টি ময়নাতদন্তের জন্য বেলগাছিয়ার প্রাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হবে।

দেবযানীকে শেষ কবে প্রকাশ্যে দেখা গিয়েছিল, তা নিয়েও এখনও স্পষ্ট কোনও জবাব মেলেনি। দেবযানীর কাকা অরুণ দে-র পরিবার জানিয়েছে, ২০০৫ সালের পর থেকে দেবযানীকে তাঁরা দেখেননি। একই কথা সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন অরুণবাবুর ছেলে অর্জুনও।

কিন্তু ওই বাড়ির অন্য এক বাসিন্দা জানিয়েছেন, ২০১২-১৩ সাল নাগাদ অসুস্থ ঠাকুমাকে দেখতে কাকার বাড়িতে যেতেন দেবযানী। বছর খানেক আগেও তিনি দেবযানীকে দেখেছিলেন বলে ওই বাসিন্দা দাবি করেন। বছর খানেক আগে দেবযানীকে দেখার কথা জানিয়েছেন ওই বাড়ির একাধিক প্রতিবেশীও। পুলিশ জেনেছে, অরুণবাবু ও অরবিন্দবাবুর মধ্যে সম্পত্তি নিয়ে মামলা রয়েছে।

অজস্র প্রশ্নের উত্তর যে হেতু ধোঁয়াশা, পুলিশ তাই পার্থবাবুকেও পুরোপুরি ক্লিনচিট দিচ্ছে না। তাঁর বয়ানে একাধিক অসঙ্গতি রয়েছে। পার্থ জানিয়েছিলেন, তিনি বোনের কঙ্কাল নিয়ে একই ঘরে থাকতেন। কিন্তু পুলিশ ওই ঘরের বিছানার চাদর পরীক্ষা করে জেনেছে, সে ঘরে কেউ শুতেন না। পার্থ তাঁর বাবার সঙ্গেই ঘুমোতেন। পুলিশের একাংশ বলছেন, খুনের সাক্ষ্য না মিললেও অরবিন্দবাবুর দেহে কয়েকটি আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। পার্থ তাঁর বাবাকে মারধর করতেন কি না, সেটাও গোয়েন্দাদের কাছে ধোঁয়াশা হয়ে রয়েছে।

পাভলভে রোগীদের কাউন্সেলিং ও পুনর্বাসনের কাজে নিযুক্ত একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রধান রত্নাবলী রায়ও এ দিন পার্থ সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁর বক্তব্য, মানসিক ভারসাম্য না-থাকলে পার্থবাবু কি এত দিন ধরে তিনটি মৃতদেহ এমন ভাবে সংরক্ষণ করতে পারতেন, যাতে এতটুকু গন্ধ বাইরে না যায়? দ্বিতীয়ত, দফায় দফায় কথা বলার পরেও চিকিৎসকেরা তাঁর ব্যক্তিগত বিষয়ে তেমন কোনও তথ্য বার করতে পারেননি। বাবা সম্পর্কে একটি কথাও তিনি বলেননি। এক জন মানসিক ভারসাম্যহীনের পক্ষে এত ক্ষণ ধরে কোনও কথা চেপে রাখা সম্ভব কি?

ডিসি (সাউথ) মুরলীধর শর্মা এ দিন বলেন, ‘‘পার্থবাবুকে ফের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’’ পার্থর বয়ান অনুযায়ী মরণাপন্ন দেবযানীকে ডাক্তার না দেখিয়ে বাড়িতে ফেলে রাখাও এক ধরনের অপরাধ। সেটা নিয়েও তদন্তকারীদের সঙ্গে কথা হচ্ছে। পুলিশ সূত্রের খবর, অরবিন্দবাবুকে অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় উদ্ধারের সময়ও পার্থ মোটামুটি স্বাভাবিক আচরণই করছিলেন। কিন্তু অরবিন্দবাবুর দেহ নিয়ে পুলিশ চলে যেতেই উত্তেজিত হয়ে ওঠেন পার্থ। এক পুলিশকর্মীর কথায়, ‘‘উনি তখন ঘরের মধ্যে ছুটোছুটি করছিলেন। ফ্রিজ থেকে জলের বোতল নিয়ে ছুড়ছিলেন।’’

এ দিন সকালে পার্থদের ফ্ল্যাটে তল্লাশি চালাতে যান ডিসি (সাউথ) ও শেক্সপিয়র সরণি থানার ওসি অরুণ দে। সঙ্গে ছিলেন হোমিসাইড শাখার গোয়েন্দারাও। তল্লাশি চালিয়ে ৩টি মোবাইল ফোন বাজেয়াপ্ত করেছেন। এর আগে ২টি ল্যাপটপ ও ৬টা ডেস্কটপ কম্পিউটার বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। ল্যাপটপগুলি খোলা গেলেও ডেস্কটপগুলি খুলতে পারেননি গোয়েন্দারা। এগুলি সাইবার ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হবে। ওই পরিবারের আয়ের উৎস সন্ধানে অরবিন্দবাবুর পাঁচটির বেশি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের নথিও বাজেয়াপ্ত করেছে পুলিশ।

abpnewsletters house of horror psycho killing debjani de debjani case skeleton case latest news shakespear sarani case latest news
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy