E-Paper

চিরশিশু শ্রেয়ানদের নাচে মনুষ্যত্বের ডাক

ডাউন সিন্ড্রোমের শিকার এই শিল্পীদের নিয়েই রবীন্দ্র নৃত্যনাট্য চণ্ডালিকা উপস্থাপনায় অনড় ছিলেন তাঁদের নাচের শিক্ষিকা, গৌড়ীয় নৃত্য শিল্পী কাবেরী পুইতণ্ডি কর।

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ২০ মে ২০২৪ ০৭:২৭
সেতুবন্ধন: সাজঘরে সহশিল্পী শুভশ্রী ঘোষের (ডান দিকে) সঙ্গে আড্ডায় মেতে শ্রেয়ান এবং উর্বী। 

সেতুবন্ধন: সাজঘরে সহশিল্পী শুভশ্রী ঘোষের (ডান দিকে) সঙ্গে আড্ডায় মেতে শ্রেয়ান এবং উর্বী।  ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা নাটকে নাচ করছে, এটুকু বুঝেছিল ১৪ বছরের শ্রেয়ান বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে ‘চণ্ডালিকা’-র গল্পটা পুরোপুরি বোঝেনি সে। বৌদ্ধ মন্দিরে দেখা সন্ন্যাসী বা ভিক্ষুর সাজে মঞ্চে উঠতে হবে, এটা জেনেই উৎসাহে ফুটছিল চিরশিশু নৃত্যশিল্পীটি। শ্রেয়ানের থেকে বয়সে কিছুটা বড়, ২৬ বছরের উর্বী বড়ুয়া। ছোট থেকেই নানা ধরনের নাচ তিনিও শিখে চলেছেন। চিরশিশু তিনিও। চণ্ডালকন্যা প্রকৃতির মায়ের চরিত্রটি ফুটিয়ে তোলা উর্বীর জন্যও নেহাতই সোজা ছিল না।

ডাউন সিন্ড্রোমের শিকার এই শিল্পীদের নিয়েই রবীন্দ্র নৃত্যনাট্য চণ্ডালিকা উপস্থাপনায় অনড় ছিলেন তাঁদের নাচের শিক্ষিকা, গৌড়ীয় নৃত্য শিল্পী কাবেরী পুইতণ্ডি কর। তিনি বলছিলেন, ‘‘চণ্ডালিকা-র অস্পৃশ্যতা জয় করে সব মানুষকে সমান চোখে দেখার বার্তা এই ছেলেমেয়েদের মতো আর কে সবার কাছে পৌঁছে দিত!’’

১৪৩১ বঙ্গাব্দের কবিপক্ষ তাই কিছুটা বিরল স্পর্ধারই স্বাক্ষর রাখল। শনিবার সন্ধ্যায় শিশির মঞ্চে রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষে সরকারি অনুষ্ঠানে খুব বেশি দর্শক ছিলেন না। কিন্তু কাবেরীর পরিচালনায় চণ্ডালিকা-র সম্পাদিত অংশের নৃত্য উপস্থাপনায় শুভশ্রী ঘোষ, অহনা সেনদের সঙ্গে সমান তালেই মঞ্চ মাতালেন উর্বী, শ্রেয়ানরা। ভেঙে গেল তথাকথিত স্বাভাবিক, অস্বাভাবিকের সীমারেখা। অনুষ্ঠান শেষে উর্বীর মা অমিতা বড়ুয়ার চোখে চিকচিক করছে খুশির অশ্রু। “আমাদের ছেলেমেয়েরা আর পাঁচ জনের মতো না-হতে পারে! কিন্তু একটু সময়, সুযোগ পেলে ওরাও সব কিছু পারে। সেই সুযোগটুকু ওদের অধিকার”, বলে ওঠেন তিনি।

“প্রতি ৭০০ জনের মধ্যে এক জনের ডাউন সিন্ড্রোম দেখা যায়”, বলছিলেন, ‘সেন্ট্রাল কলকাতা ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন ফর পার্সনস উইথ ডাউন সিন্ড্রোম’ বলে একটি সংগঠনের সহ-সভাপতি চৈতালি গামী। তাঁর মেয়েও ডাউন সিন্ড্রোম নিয়েই ফরমায়েশি খাবারের ব্যবসা সামলে লড়ে যাচ্ছেন। চৈতালি বললেন, “ডাউন সিন্ড্রোমে বোধ বা বুদ্ধির একটা ফারাক থাকে। কারও ক্ষেত্রে সামান্য ,কারও মাঝারি কারও বা তীব্র ফারাক। চেহারা, হাঁটাচলায়ও ওঁরা খানিকটা আলাদা। কিন্তু অল্প বয়স থেকে তালিম পেলে ওঁরাও অনেক কিছুই করতে পারেন। হয়তো একটু বেশি সময় লাগে।”

যেমন উর্বী এখন মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক স্তরে ইতিহাস পড়ছেন। ডাউন সিন্ড্রোমে নড়াচড়ায় একটু সময় লাগে অনেকের। প্রকৃতির মায়ের চরিত্রে ‘আয় তোরা আয়’ বলে দ্রুত লয়ের মায়া নৃত্যে উর্বী কিন্তু নিজেকেও ছাপিয়ে গেলেন। শ্রেয়ানের হাঁটা একটু ধীরে, দুটো পা ফাঁক করে। অনেকের ভয় ছিল, চশমা ছাড়া হাঁটতে বেচারি মুশকিলে পড়বে। বৌদ্ধ সন্ন্যাসী আনন্দের ভূমিকায় তার ঋজু উপস্থিতিতে পরিচিতেরা এক কথায় অভিভূত। এই গরমেও নিয়মিত মহড়া দিয়েছেন শিল্পীরা। এই চণ্ডালিকায় আর্থিক ভাবে পিছিয়ে থাকা ঘরের কয়েক জনও অংশ নিয়েছেন। কাবেরী বলছিলেন, “মহড়ার অল্প সুযোগেই উর্বী, শ্রেয়ানরা খুব ভাল করেছে!”

অনুষ্ঠান শেষে সাজঘরে গিয়ে দেখা গেল শিল্পীরা খোশগল্পে মশগুল। অমুক ওটিটি সিরিজ থেকে আইপিএলে ধোনি-বিরাটের দ্বৈরথ নিয়ে একটু আধো বুলিতে শ্রেয়ানের মুখে খই ফুটছে। যেন নানা মাপের নানা বয়সের শিশুদের ফারাক মোছা এক সম্মেলন। তাতে চণ্ডালিকার আনন্দ-র গানে, ‘যে মানব আমি সেই মানব তুমি’র মহামন্ত্রটিই মূর্ত, উজ্জ্বল।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Down Syndrome Artists Dance Drama

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy