Advertisement
০২ জুন ২০২৪

হেলমেট ছাড়া ক্লাসে নয়, নয়া দৃষ্টান্ত স্কুলে

‘নো হেলমেট, নো পেট্রোল’-এর পরে এ বার ‘নো হেলমেট, নো ক্লাস’। পড়ুয়াদের জন্য প্রায় এমনই নিদান দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করল এই শহরেরই একটি স্কুল।

চলো নিয়মমতে। বুধবার, সেই স্কুলের সামনে। — স্বাতী চক্রবর্তী

চলো নিয়মমতে। বুধবার, সেই স্কুলের সামনে। — স্বাতী চক্রবর্তী

শিবাজী দে সরকার ও সুপ্রিয় তরফদার
শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০১৬ ০২:৪৮
Share: Save:

‘নো হেলমেট, নো পেট্রোল’-এর পরে এ বার ‘নো হেলমেট, নো ক্লাস’। পড়ুয়াদের জন্য প্রায় এমনই নিদান দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করল এই শহরেরই একটি স্কুল।

‘সেন্ট জোসেফ্‌স কলেজ’ নামে ওই স্কুল সূত্রের খবর, গত সপ্তাহেই অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগের নির্দিষ্ট অ্যাপ, নোটিস বোর্ড এবং পড়ুয়াদের নির্দিষ্ট ডায়েরির মাধ্যমে নার্সারি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সকল পড়ুয়ার অভিভাবকদের জানানো হয়েছিল, যে পড়ুয়ারা মোটরবাইকে করে আসে, তাদের মাথায় হেলমেট থাকা বাধ্যতামূলক। এই নির্দেশ না মানলে তারা ক্লাস করার অনুমতি না-ও পেতে পারে। তার পরেও অভিভাবকদের সম্বিৎ ফেরেনি বলে দাবি স্কুলেরই এক আধিকারিকের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই আধিকারিক বলেন, ‘‘প্রতিদিন সকাল সাড়ে সাতটায় স্কুল শুরু হওয়ার আগেই স্কুলের প্রধান গেটে রক্ষীর ভূমিকায় চলে আসছেন খোদ অধ্যক্ষা জয়তী বন্দ্যোপাধ্যায়। গত সোমবার থেকেই হেলমেট ছাড়া পড়ুয়াদের আটকে দেওয়া হচ্ছে। এটা চলতে থাকবে।’’

স্কুল সূত্রে খবর, কয়েক দিন আগে কাগজে একটি খবর বেরোয়, হেলমেট ছাড়া স্কুটিতে করে স্কুলে যাওয়ার সময়েই দুর্ঘটনায় পড়ে তিন ছাত্র। দু’জনের মৃত্যু হয়। এক জন এখনও মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। তা পড়েই বৌবাজারের সেন্ট জোসেফ্স কলেজের (স্কুল) অধ্যক্ষা জয়তী বন্দ্যোপাধ্যায় ঠিক করেন, তাঁর কোনও ছাত্র যেন এমন মর্মান্তিক পরিণতির স্বীকার না হয়, তা তিনি দেখবেন। নোটিস জারি করেন তিনি: ‘নো হেলমেট, নো ক্লাস’। সাধারণত, স্কুল শুরুর সময়ে সামনের রাস্তা যদুনাথ মল্লিক রোডে ট্র্যাফিক চলাচল কিছুটা সামলায় স্কুলেরই উঁচু ক্লাসের ছাত্রেরা। সঙ্গে রাস্তায় নামেন জয়তীদেবীও। যে সব অভিভাবক হেলমেট ছাড়া পড়ুয়াদের পৌঁছতে আসেন, তাঁদের তিনি জানিয়ে দেন, হেলমেট পরিয়েই ছেলেদের আনতে হবে। জয়তীদেবীর কথায়, ‘‘মূলত ছাত্র ও অভিভাবকদের সচেতন করতেই এই পদক্ষেপ।’’ খানিকটা ফলও হয়েছে। তবে জয়তীদেবীর আক্ষেপ, ‘‘কিছু অভিভাবক এখনও এর গুরুত্ব বুঝতে পারছেন না। কিছুটা দূরে ছেলেদের নামিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন। তবু হেলমেট পরাচ্ছেন না।’’ তবে তাঁরা চেষ্টা চালিয়ে যাবেন, জানান অধ্যক্ষা।

পথ-দুর্ঘটনায় রাশ টানতে কয়েক মাসে আগেই এক অনুষ্ঠানে ট্র্যাফিক আইন মানার পরামর্শ দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মোটরবাইক চালক এবং আরোহীদের মাথায় হেলমেট পরার কথাও বলেছিলেন তিনি। এর পরে কলকাতার পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমার শহরের প্রতিটি পেট্রোল পাম্প কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন, হেলমেট না থাকলে কোনও মোটরবাইককে যেন পেট্রোল দেওয়া না হয়। কিন্তু ওই নির্দেশের পরেও হুঁশ ফেরেনি শহরের বাসিন্দাদের একাংশের। একের পর এক পথ-দুর্ঘটনায় মৃত্যু মিছিল লেগেই রয়েছে। সেই অবস্থায় একটি স্কুলের এ রকম পদক্ষেপের প্রশংসা করেছেন অভিভাবক, পুলিশ এবং অন্যান্য স্কুলের কর্তৃপক্ষও।

সেন্ট জোসেফ্‌স কলেজের দশম শ্রেণির পড়ুয়া হামজা সামসির অভিভাবক মেছুয়া এলাকার বাসিন্দা পাপ্পু সামসি। পাপ্পু সাহেব বুধবার বলেন, ‘‘প্রতিদিনের মতো মঙ্গলবারও ছেলেকে নিয়ে স্কুলে এসেছিলাম। ওর মাথায় হেলমেট ছিল না। তাই ছেলেকে স্কুলে ঢুকতেই দেয়নি। দরজায় অধ্যক্ষা দাঁড়িয়ে গোটা বিষয়টি তদারক করছিলেন।’’ তিনি জানান, এর পরে হামজাকে স্কুলের সামনেই দাঁড় করিয়ে চাঁদনি এলাকার এক পরিচিতের কাছে যান তিনি। তাঁর থেকে হেলমেট নিয়ে এসে ছেলের মাথায় পরিয়ে তবেই স্কুলে ঢোকান। তার পরে বাড়ি ফিরেই নতুন হেলমেট কেনেন পাপ্পু সাহেব। বুধবার থেকে ছেলেকে হেলমেট পরিয়েই স্কুলে নিয়ে আসছেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘স্কুলের তরফে আগেই জানানো হয়েছিল। নোটিস বোর্ডেও লেখা ছিল, ‘নো হেলমেট, নো ক্লাস।’ আমাদের সন্তানদের ভালর জন্যই স্কুল এটা করছে। আমি সমর্থনও করি।’’ ভুল স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘‘আমি অন্যদেরও বলেছি, ছেলেকে হেলমেট পরিয়েই স্কুলে নিয়ে যেতে। গত তিন দিনে অনেক পড়ুয়াই ক্লাস করতে পারেনি। অভিভাবকদের ভুলের শিকার হচ্ছে সন্তানেরা।’’ অন্য এক অভিভাবক বলেন, ‘‘এটা আরও আগে থেকে শুরু হলে ভাল হত। ক্লাসে ঢুকতে না দেওয়ার ভয়ে এখন সকলেই স্কুলের নির্দেশ মানছেন।’’

হেলমেট নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার পরেই হেলমেট পরার নিদান দিয়েছিল বেশ কিছু স্কুল। কিন্তু সচেতনতার অভাবে তা বাস্তবায়িত করা যায়নি বলে স্বীকারও করে নিচ্ছেন বেশ কয়েকটি স্কুলের কর্তৃপক্ষ। সেন্ট্রাল মডার্ন স্কুলের অধ্যক্ষ নবারুণ দে বলেন, ‘‘অভিভাবকেরা ছেলে-মেয়েদের মাথায় হেলমেট তো দেনই না। উল্টে নিরাপত্তারক্ষীরা ঢুকতে বাধা দিলে তাঁদের সঙ্গে তর্কাতর্কি শুরু করে দেন। অভিভাবকদের একাংশের অসচেতনতার জন্যই এই উদ্যোগকে বাস্তবায়িত করা যাচ্ছে না।’’ তিনি জানান, হেলমেট না থাকার কারণে ক্লাস বন্ধ করলে অভিভাবকদের জন্য পড়ুয়াদের দুর্ভোগ হবে। সে কারণেই করা হয়নি। তবে এ বার নতুন করে কড়া পদক্ষেপ করা হতে পারে বলে জানান তিনি। সাউথ পয়েন্ট স্কুলের মুখপাত্র কৃষ্ণ দামানি বলেন, ‘‘ক্লাস বন্ধ করলে পড়ুয়াদের ক্ষতি হবে। তাই এটা সমর্থনযোগ্য নয়। আমাদের স্কুলে মোটরবাইকে করে আসা পড়ুয়াদের সংখ্যাও কম। সে কারণেই এ রকম কোনও বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়নি। এটা একেবারেই অভিভাবকদের সচেতনতার বিষয়।’’

তবে এই পদক্ষেপকে সমর্থন করে ক্যালকাটা বয়েজের অধ্যক্ষ রাজা ম্যাকগি বলেন, ‘‘আমরাও হেলমেট পরানোর জন্য বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিলাম। কিন্তু নজরদারি চালানো সম্ভব হয়নি। সেন্ট জোসেফ্‌স কলেজের পদক্ষেপ প্রশংসনীয়।’’ পাঠভবনের প্রধান শিক্ষিকা সান্ত্বনা রায় বলেন, ‘‘হেলমেট পরে আসার বিষয়ে কোনও বিজ্ঞপ্তি আমাদের স্কুলে দেওয়া হয়নি। কিন্তু ওই স্কুলের উদ্যোগ খুবই ভাল লাগছে। আমরাও কিছু করতে পারি কি না, সেটা নিয়ে শীঘ্রই আলোচনা করব।’’ সেন্ট জোসেফ্স কলেজের পদক্ষেপকে প্রশংসা করে হিন্দু স্কুলের প্রধান শিক্ষক তুষারকান্তি সামন্ত বলেন, ‘‘নোটিস বোর্ডে আমরা হেলমেট পরার বিষয়টি জানিয়েছিলাম। স্কুলে প্রার্থনার সময়েও পড়ুয়াদের সচেতন করা হয়। কিন্তু নজরদারি চালানো হয়নি।’’

কলকাতার অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (১) বিনীত গোয়েল বলেন, ‘‘ওই স্কুলের উদ্যোগকে স্বাগত জানাচ্ছি। অন্য সব স্কুলও এ ভাবে উদ্যোগী হলে দ্রুত সচেতনতা বাড়বে। পুলিশের তরফ থেকেও পড়ুয়াদের মধ্যে সচেতনা প্রসারের কাজ চলছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

No helmet no class School
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE