মগডালে উঠে বসেছেন আরিমা টাকেরু। — নিজস্ব চিত্র
রাতভর শহরে ‘জাপানি সন্ত্রাস!’
ইতিহাস বলে, কয়েক দশক আগে ‘জাপানি বোমা’র ভয়ে রাতের কলকাতা আলো নিভিয়ে আঁধারে লুকিয়ে থাকত। সোমবার যেন সেই রাতই ফিরে এল আবার। সৌজন্যে, এক জাপানি পর্যটক।
আড়াই বছরের মেয়েকে রাতের খাবার খাইয়ে সবে ঘুমপাড়ানি গান ধরেছেন মা। হঠাৎ খুকখুক কাশির আওয়াজ। ঘরে তো আর কেউ নেই! কয়েক সেকেন্ড পরে ফের কাশির শব্দ। যেন বাইরে থেকেই আসছে। হ্যাঙার হাতে এ বার বারান্দায় এসেই চক্ষু চড়কগাছ— বাড়ির পিছনের নিম গাছটায় কে একটা বসে পা দোলাচ্ছে! ‘‘ও মা গো! কে যেন দুলছে!’’ গিন্নির চিৎকারে দোতলা থেকে নৈশভোজ ফেলে ছুটে এলেন কর্তা। পরিবারের অন্যেরাও। গাছের ডাল থেকেও তখন অচেনা শব্দে পাল্টা চিৎকার!
খাওয়া মাথায়। চেঁচামেচিতে জড়ো হয়ে গিয়েছে গোটা পাড়া। লোক যত বাড়ছে, গাছের ডালেও ততই বাড়ছে চিৎকারের তীব্রতা। খবর গেল পুলিশে।
পুলিশ জানায়, তপসিয়া থানার ক্রিস্টোফার রোডের ওই বাড়ির নিমগাছে উঠে পড়েছিলেন এক জাপানি যুবক। তাঁকে নিয়েই রাতভর নাজেহাল হন এলাকাবাসী, কলকাতা পুলিশ, দমকল বাহিনী এবং রাজ্যের বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের কর্মীরা।
মঙ্গলবার গৃহকর্ত্রী মোমিকা দাস জানান, রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ প্রথম ওই যুবকের দেখা মেলে গাছের ডালে। পরিবারের সদস্য ও পাড়ার লোক জড়ো হতে দেখে চেঁচাতে চেঁচাতে আরও উঁচু ডালে উঠতে থাকেন যুবক। দাস পরিবার একাধিক বার তাঁর নাম জানতে চাইলেও জবাব মেলেনি। এর পরে রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ পুলিশ আসে বলে জানান মোমিকাদেবী।
এক পুলিশকর্তার কথায়, যুবককে গাছ থেকে নামতে বললে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে তিনি বলেন, ‘কল জাপানিজ পুলিশ’। জাপানি ভাষা জানা গাইডকে আনা হয় ঘটনাস্থলে। তিনিও কথা বলে কিছু বুঝতে পারেননি।
রাত ১২টা নাগাদ আসে দমকল। ততক্ষণে চিৎকার বেড়েছে। গলাও ধরে আসছে। পরনের প্যান্ট ও টি-শার্ট খুলে নিংড়ে নিংড়ে জল খাচ্ছিলেন যুবক। দমকলকর্মীরা গাছে মই লাগাতে গেলে লাথি মেরে তা ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। এক দমকল-কর্তা কোনওক্রমে মই বেয়ে কিছুটা উঠে পায়ে দড়ি বাঁধার চেষ্টা করেন। যুবক উঠে যান মগডালে। দমকল-কর্তারা এ বার আশপাশের আলো নিভিয়ে দিতে বলেন। আশা ছিল, অন্ধকারে যুবককে কাবু করা যাবে। কিন্তু অনেক কসরতেও কার্যসিদ্ধি হয়নি।
এ বার আসেন দোভাষী। মইয়ে দাঁড়িয়েই যুবকের সঙ্গে কথা বলা শুরু করেন তিনি। এর পরেই রাত দেড়টা নাগাদ ধাঁধাটা কিছুটা পরিষ্কার হয়। দোভাষী পুলিশকে জানান, যুবকের নাম আরিমা টাকেরু। বয়স চব্বিশ। ভারত ভ্রমণে এসে দিন চারেক আগে কলকাতার সদর স্ট্রিটের হোটেলে উঠেছেন আরও ক’জন জাপানির সঙ্গে। সোমবার থেকেই পাসপোর্ট, ভিসা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। বিকেলে টেরিটিবাজারের কাছে কয়েক জন পুলিশকর্মী জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলে ভাষার অসুবিধায় কিছু বুঝতে পারেননি। পাসপোর্ট হারানোর ভয়ে তাঁদের ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে দৌড়ে সিগন্যালে দাঁড়ানো ট্যাক্সিতে উঠে পড়েন আরিমা। তাতে ছিলেন এক মহিলা যাত্রী। আচমকা ট্যাক্সিতে যুবককে উঠতে দেখে চিৎকার জোড়েন তিনি। ঝামেলা না বাড়িয়ে চটপট ট্যাক্সি থেকে নেমে ছুট দেন আরিমা।
বড় রাস্তা পার করে সরু গলি। তার মুখেই একটি পুকুর। ছুটতে ছুটতে তাতে পড়ে যান যুবক। ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমেছে। সাঁতরে পাড়ে পৌঁছে আরিমা দেখেন সামনের বড় বাড়িটায় আলো জ্বলছে। পুকুরপাড় থেকেই নিমগাছে উঠে পড়েন তিনি। দোভাষীকে নিজের পরিচয় দেন ‘টপ সিক্রেট’ বলে। কেন, তার ব্যাখ্যা অবশ্য দেননি।
দোভাষী বারবার নেমে আসতে বললেও আরিমা কান দেননি। শেষমেশ রাত আড়াইটে নাগাদ হঠাৎ ‘ড্রিঙ্ক ওয়াটার, ড্রিঙ্ক ওয়াটার!’ বলে চিৎকার। বাড়ির সদস্যেরা জল এগিয়ে দেন মইয়ে চড়া দমকল-কর্তার হাতে। যুবকের দিকে জলভরা বোতল এগিয়ে দিলে তিনি দমকল-কর্তাকেই প্রথমে জল খেতে বলেন। তিনি খেলে তবেই ওই বোতল থেকে জল খান যুবক।
মঙ্গলবার ভোর সাড়ে ৩টে নাগাদ পুলিশ ও দমকল বাড়ির মূল ফটক বন্ধ করে দেয়। ভিড়ও ফাঁকা করতে বলে। বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের কর্মীরা এসে বাড়ির পাঁচিল লাগোয়া পুকুরে জাল বিছিয়ে রাখেন। সকাল সাড়ে ছ’টা নাগাদ গাছ থেকে পুকুরে ঝাঁপ দেন আরিমা। জল থেকে উঠে ফের পালাতে গেলে পুলিশ তাঁকে ধরে ফেলে। এ দিন সকালে তপসিয়া থানায় নেওয়া হয় আরিমাকে। ইতিমধ্যে সদর স্ট্রিটের হোটেল থেকে বন্ধুরা পুলিশকে জানান, পাসপোর্টটি মিলেছে। কিন্তু আরিমা পুলিশকে বলেন, তিনি জাপানি কনস্যুলেটের সঙ্গে কথা বলতে চান। পুলিশ সেখানে পাঠায় তাঁকে। এক পুলিশকর্তা বলেন, ‘‘কর্তারা যেমন বলবেন, সেই মতো কাজ হবে। এটা আন্তঃরাষ্ট্রীয় বিষয়। তাই পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে কিছু বলতে পারব না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy