Advertisement
E-Paper

মৃত্যুর মধ্যেও জীবন খুঁজছে ‘গ্রাউন্ড জিরো’

মৃত্যুকে আলিঙ্গনের পরে ২৪ ঘণ্টা কেটেছে। চোখেমুখে অস্থিরতার ভাষা পড়তে পারলেও বৃদ্ধের কথায় তেমনটা মনে হবে না। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, কপালে লাল টিপ, ফতুয়া আর ধুতি পরিহিত বৃদ্ধ বলছেন, ‘‘ভয় পাই না। আমি পূজারী।

তাপস সিংহ

শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০১৬ ১৭:৫১

মৃত্যুকে আলিঙ্গনের পরে ২৪ ঘণ্টা কেটেছে।

চোখেমুখে অস্থিরতার ভাষা পড়তে পারলেও বৃদ্ধের কথায় তেমনটা মনে হবে না। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, কপালে লাল টিপ, ফতুয়া আর ধুতি পরিহিত বৃদ্ধ বলছেন, ‘‘ভয় পাই না। আমি পূজারী। কিন্তু চোখের সামনে পর পর মৃত্যু দেখেছি কাল। দেখেছি, মানুষ কী ভাবে চলে যেতে পারে! তার পরে ভেবেছি, ওদের জায়গায় তো আমিও থাকতে পারতাম! থাকিনি যে, সেটা স্রেফ দুর্ঘটনা! এই আজ দুপুরে আপনার সামনে বসে থাকাটা যেমন। আসলে, কালকেই আমি মৃত্যকে আলিঙ্গন করেছি।’’ চন্দ্রবালী তিওয়ারির গলায় অদ্ভুত নির্লিপ্তি।

কালীকৃষ্ণ ঠাকুর স্ট্রিটের সুপ্রাচীন এই বাড়ির অবস্থান বিবেকানন্দ রোডের ঠিক ধারেই। কাল দুপুর সাড়ে ১২টায় এর ঠিক পাশেই হুড়মুড়িয়ে যেন মাটি ছুঁয়েছিল বিশ্বকর্মারই এক সৃষ্টি। গগনভেদী আওয়াজ তুলে, চতুর্দিকে ধ্বংসলীলা চালিয়ে সেই নির্মাণ যখন তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে, সে সময়ে এই বাড়িতেই ছিলেন চন্দ্রবালী। শুক্রবার দুপুরে, এ বাড়িরই সদর দরজার ধারে সিমেন্টের রকে বসে বৃদ্ধ যেন আনমনে বলতে থাকেন, ‘‘ওরা বলেছিল, সেতুটা তাড়াতাড়ি চালু করতে হবে। সে ভাবেই তো কাজ চলছিল। কী ভাবে চলছিল? দেখে যান। সেতুটা যে আসলে কালকেই উদ্বোধন হয়ে গিয়েছে, ওই প্রাণগুলোর বিনিময়ে...’’

আরও পড়ুন: উড়ালপুলের সাবকন্ট্রাক্ট শাসক নেতার ভাইপোকে! জড়াচ্ছে তৃণমূলের নাম

একেই কি বলে ‘গ্রাউন্ড জিরো’? দাঁড়িয়ে আছি রবীন্দ্র সরণি আর বিবেকানন্দ রোডের মোড়ে। রাস্তার ঠিক মাঝখানে ট্রামলাইনের উপর আর চারপাশে কংক্রিটের আস্তরণ উঠে গ্রামের রাস্তার মতো চেহারা নিয়েছে। বৃহস্পতিবার সারা রাত রাস্তার মাঝখানের ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজ চলেছে। এ দিনও সকাল থেকে বুলডোজার নিয়ে উদ্ধারকারীরা কাজ করে চলেছেন। পাথর খাদানের মতো সূক্ষ্ণ ধুলো ভরিয়ে দিচ্ছে নাক-চোখ। বিবেকানন্দ উড়ালপুলের দু’টি বাহু হুড়মুড়িয়ে নেমে এসেছে মাটিতে। লোহার বিম, রড, সিমেন্টের চাঙড়, বাড়ির বারান্দা, চেপ্টে যাওয়া গাড়ি, অটো, ভ্যান— যেন কোনও এক বিরাট শিশু বিরক্ত হয়ে তাসের ঘরের মতো ভেঙে ফেলতে চেয়েছে সেটি!

তারই মধ্যে কর্ডনের ফাঁক গলে ঢেউয়ের মতো জনস্রোত, আটকে পড়া দেহের সন্ধানে ইতিউতি চোখ, ধ্বংসস্তূপের ছবি তোলার হিড়িকের মধ্যেই হঠাৎ উৎসাহী জনতাকে হঠাতে লাঠি উঁচিয়ে তেড়ে আসে পুলিশ, জনতা হইহই করে দৌড়ে পিছিয়ে আসে। কিন্তু তা নিতান্তই ক্ষণস্থায়ী! জনতা আবার এগোতে থাকে ধ্বংসস্তূপের দিকে। অসহায় গলায় এক পুলিশ অফিসার বলেন, ‘‘কী যে করব! একে এই পরিস্থিতি, তার মধ্যে গ্যালারি সামলাতে হচ্ছে।’’

গ্যালারিই বটে! বিবেকানন্দ রোডের উপর গণেশ টকিজের ঠিক উল্টো দিকে উড়ালপুলের লোহার বিমের তলায় কমলারঙা দশ চাকার যে ভারী ট্রাকটি এখনও আটকে, তার নম্বর পড়া গেল, AP21 TZ0690। এই ট্রাকের চালকের কেবিনে এখনও না কি আটকে একটি দেহ। গুঁড়ি মেরে, ফুটপাথের ভেঙে পড়া রেলিংয়ের ফাঁক দিয়ে ট্রাকটির যতটা পারা যায় কাছে গিয়ে মোবাইলে ছবি তুলতে ব্যস্ত এক মহিলা পুলিশকর্মী। তাঁরই পাশ দিয়ে আরও বেশ কিছু মোবাইল একই কাজে ব্যস্ত।


এরকম সময়েও সেলফি তুলতে ব্যস্ত অনেকে।

রাস্তার ধারে নীলরঙা প্লাস্টিকের চাদরে ঢাকা উদ্ধার হওয়া দু’টি গাড়ি পাশাপাশি রাখা। একেবারে চেপ্টে যাওয়া, গ্যাসকাটার দিয়ে পুড়িয়ে কোনওক্রমে বার করা সেগুলিকে গাড়ি বলা যায় খুব কষ্ট করে। একটির নম্বর পড়া গেলেও আর একটির প্রশ্নই নেই। সেই ছোট ধ্বংসস্তূপ ঘিরে রাখা জনতার মধ্য থেকে আওয়াজ উঠল, ‘আরে প্লাস্টিকটা সরিয়ে দে তো, ভাল ছবি তোলা যাচ্ছে না!’ সংবাদ মাধ্যমকে দূরে সরাতে যে পুলিশকর্মীরা সক্রিয়, সেই তাঁরাই কিন্তু জনতাকে বাধা দিয়ে বলছেন না, ওগুলোর ফরেন্সিক পরীক্ষা এখনও হয়নি।

ভয়ঙ্কর উত্তেজিত শোনায় কালীকৃষ্ণ ঠাকুর স্ট্রিটের বাসিন্দা শান্তনু দে-র গলা। ‘‘জানেন, কাল ঠিক ১২টা ১০ মিনিট নাগাদ এখান দিয়েই ছেলেকে স্কুল থেকে নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। তার ঠিক মিনিট কুড়ির মধ্যেই ভয়ঙ্কর আওয়াজ কানে এল। ছুটে গেলাম রাস্তায়। তার পরে তো ওই...রক্ত, আর্তনাদ, মৃত্যু।’’ খানিকটা চুপ করে থেকে চিৎকার করে ওঠেন শান্তনুবাবু, ‘‘একটা লোক সেই সময়েই প্রচুর ছবি তুলছিল মোবাইলে। তাকে বললাম, ‘দাদা, কেমন উঠছে ছবি?’ একগাল হেসে লোকটা বলল, ‘দারুণ ছবি পেয়েছি দাদা লোকগুলোর।’ আমি আর থাকতে পারিনি জানেন, টেনে একটা চড় মারলাম লোকটাকে! আর পারিনি ধৈর্য রাখতে।’’

এটাও তো জীবন! শুক্রবার সকাল থেকে কোথায় ক’টা দেহ উদ্ধার হল তা নিয়ে জল্পনাকল্পনার মধ্যেই উড়ালপুলের আশপাশের বাড়ির লোকজন জানালেন, তাঁদের অস্থায়ী ভাবে বাড়ি ছাড়তে বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, গোটা এলাকা আপাতত খালি করে দেওয়া হবে। কোথায় যাবেন তাঁরা, জানেন না। যেমন জানেন না, এই উড়ালপুল আবার কবে তৈরি হবে, আদৌ হবে কি না।

তবু, তারই মধ্যে জীবনের ছন্দ খুঁজছে গোটা এলাকা। দোকানপাট কিছু কিছু খুলছে, মানুষজন কাজে বেরোচ্ছেন, কেউ কেউ দোকান না খুললেও ঘরে বসেই ব্যবসার কাজ চালাতে শুরু করেছেন।

জীবন তো এ ভাবেই ছন্দ খোঁজে! গ্রাউন্ড জিরো-তেই বা তার ব্যতিক্রম হবে কেন!

flyover vivekananda flyover kolkata collaps
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy