Advertisement
০৫ মে ২০২৪

পুলিশি বিরোধে গুলিযুদ্ধ মানছে পুলিশই

শাসক দল ও পুলিশের ছাতায় দিব্য ছিল কালী-দুর্গা, ডাবলু-ছোটকা ও তাদের সঙ্গীসাথিরা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে সিন্ডিকেট ও দাপটের লড়াইটা মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়াতেই এখন ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে পুলিশকে। অল্প কথায় এ ভাবেই কবরডাঙায় ধুন্ধুমার বন্দুকবাজি ও এক যুবকের মৃত্যুর ব্যাখ্যা দিচ্ছেন পুলিশ-কর্তাদের একটি অংশ।

আলিপুর আদালতে  গণেশ অধিকারী। — নিজস্ব চিত্র।

আলিপুর আদালতে গণেশ অধিকারী। — নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০১৫ ০২:৫৬
Share: Save:

শাসক দল ও পুলিশের ছাতায় দিব্য ছিল কালী-দুর্গা, ডাবলু-ছোটকা ও তাদের সঙ্গীসাথিরা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে সিন্ডিকেট ও দাপটের লড়াইটা মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়াতেই এখন ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে পুলিশকে। অল্প কথায় এ ভাবেই কবরডাঙায় ধুন্ধুমার বন্দুকবাজি ও এক যুবকের মৃত্যুর ব্যাখ্যা দিচ্ছেন পুলিশ-কর্তাদের একটি অংশ। তাঁরা এ-ও কবুল করছেন, দুষ্কৃতী-রাজকে প্রশ্রয়ের প্রশ্নে লালবাজারের গোয়েন্দা বিভাগ ও স্থানীয় কবরডাঙ্গা থানা যে কার্যত দু’টি ভিন্ন শিবিরে ভাগ হয়ে গিয়েছিল, সেটাই ফের সামনে নিয়ে এসেছে কবরডাঙার ঘটনা।

প্রয়োজনীয় অনুমতি না থাকলেও ওই পানশালায় খদ্দেরদের বিনোদনের জন্য গানের ব্যবস্থা ছিল। চলত অশ্লীল নাচও। সেই পানশালার গা ঘেঁষেই ছিল পুলিশ কিয়স্ক। কিন্তু এত দিন ব্যবস্থা নিতে গা করেনি স্থানীয় থানা। এ বার নিতে হচ্ছে। হরিদেবপুরের কবরডাঙায় বৃহস্পতিবার ধুন্ধুমার বন্দুকবাজি ও এক যুবকের নিহত হওয়ার ঘটনার জেরে শেষ পর্যন্ত সেই পানশালার মালিকদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে পুলিশ। শুক্রবার গভীর রাতে বেহালা থেকে ধরা হয়েছে গণেশ অধিকারী এক দষ্কৃতীকে। পুলিশের দাবি, গণেশ কবুল করেছে, ঘটনার রাতে সে দু’টি বোমা ছুড়েছিল। টার্গেট ছিল কালী।

তদন্তকারীদের একাংশ জানাচ্ছেন, খাতায়-কলমে পানশালার মালিক অজয় মোদী-সহ তিন জন হলেও সেটি চালান কালী সিংহ ও দুর্গা সিংহ নামে দুই ভাই, যাঁদের বাড়ি ওই তল্লাটেই। এই দু’ভাই স্থানীয় তৃণমূল কাউন্সিলর রঘুনাথ পাত্রের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। তাঁদের সঙ্গে জমির কারবার ও ইমারতি ব্যবসার সিন্ডিকেট নিয়ে গণ্ডগোল রয়েছে ডাবলু ও ছোটকা নামে দু’জনের। পানশালায় গুলিযুদ্ধ তারই জেরে। নগরপাল সুরজিৎ কর পুরকায়স্থের কথায় যা কি না ‘বিক্ষিপ্ত ঘটনা’। কিন্তু পুলিশকর্তাদের একটি অংশ বলছেন, এটা অনিবার্য করে তুলেছিল পুলিশেরই একাংশ। তারাই এর জমি তৈরি করে দিয়েছেন এলাকায় সিন্ডিকেট-রাজ, গুন্ডাবাজি ও পানশালার বেআইনি কাজকর্মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে।

এখন কী ব্যবস্থা নিচ্ছে পুলিশ?

লালবাজার সূত্রের খবর, পানশালায় গানের ব্যবস্থা রাখতে ‘ক্রুনার লাইসেন্স’ প্রয়োজন হয়। যা ওই পানশালার ছিল না বলে পুলিশের দাবি। শনিবার কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (সদর) রাজীব মিশ্র জানান, ওই পানশালার মালিকদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করা হয়েছে। নিয়ম ভেঙে পানশালা চালানোর বিষয়টি আবগারি কমিশনারকেও জানাবে লালবাজার। পানশালার অন্যতম মালিক অজয় মোদী অবশ্য বলছেন, ওই লাইসেন্স তাঁদের রয়েছে। সেই সঙ্গে তাঁর প্রশ্ন, ‘‘আয় বাড়াতে বারে একটু নাচানাচির ব্যবস্থা থাকলে ক্ষতি কী?’’

বেহালা থেকে ধৃত গণেশকে শনিবার আদালতে হাজির করানো হলে আলিপুরের ভারপ্রাপ্ত অতিরিক্ত মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট তাসি ফুনসেক তাকে সাত দিনের জন্য পুলিশি হাজতে পাঠিয়েছেন। পুলিশ সূত্রের খবর, গণেশ তাদের জানিয়েছে, বুধবার রাতে পানশালার গোলমালে কালী-দুর্গা তাকে ও তার দলের কয়েক জনকে বেধড়ক মারধর করে। সে কথা থানাকে জানালেও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উল্টে তাদেরই এলাকা ছেড়ে যেতে বলেছে। সেই রাগ মেটাতেই কালীকে ‘টার্গেট’ করে এসেছিল তারা।

পুলিশের দাবি, কবরডাঙার একটি জলাজমি ভরাট নিয়ে কালী-দুর্গার সঙ্গে ডাবলু-ছোটকার গণ্ডগোল সম্প্রতি তীব্র আকার নিয়েছিল। এলাকায় চাপা উত্তেজনা ছিল তা নিয়ে। বুধবার রাতে পানশালায় গোলমালের জেরে দু’পক্ষের সেই বিরোধই চূড়ান্ত আকার নেয়। গুলিবৃষ্টিতে মুখ্য ভূমিকা নেয় ডাবলু-ছোটকার শাগরেদ নান্টি, বাপ্পা, ভোৎকারাই।

এত দিন তবে পুলিশ কী করছিল?

এই প্রসঙ্গে বাহিনীর একাংশকেই কাঠগড়ায় তুলছেন লালবাজারের কর্তাদের একটি অংশ। তাঁরা বলছেন, লাইসেন্সহীন পানশালা ও সিন্ডিকেট-রাজের পাশাপাশি গোয়েন্দা বিভাগের গুন্ডাদমন শাখার সঙ্গে স্থানীয় থানার বিরোধের বিষয়টিও ফের সামনে এনে দিয়েছে কবরডাঙার ঘটনা। স্থানীয় দুষ্কৃতীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা বা ‘সোর্স মেনটেন’-এর ক্ষেত্রে কার্যত দু’টি দলে ভাগ হয়ে গিয়েছিলেন হরিদেবপুর থানা ও গোয়েন্দা বিভাগের অফিসারেরা। কী রকম?

লালবাজারের এক পুলিশকর্তা বলেন, ‘‘আমাদের কয়েক জন অফিসারও যেন সিন্ডিকেট তৈরি করেছিলেন। থানার অফিসারদের কয়েক জন মদত দিতেন কালী-দুর্গা এবং ওদের পানশালাকে। আবার গুন্ডাদমন শাখার কয়েক জন অফিসারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রয়েছে ডাবলু-ছোটকাদের।’’ যেমন, গত বছর পুজোর আগে ওই বারে হানা দিয়েছিলেন গুন্ডাদমন শাখার অফিসারেরা। গভীর রাতেও নাচ-গান চলছিল সেখানে। গুন্ডাদমন শাখার বক্তব্য, থানাকে সব তথ্য দিয়ে গেলেও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

কেন? পুলিশের একাংশ বলছে, রাজনৈতিক চাপের জন্যই ওই পানশালা ও কালী-দুর্গার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নিতে পারেনি পুলিশ। এর আগে সক্রিয় হয়ে এক ওঠা সাব-ইনস্পেক্টরকে এক ঘণ্টার নোটিসে বদলি করা হয়েছিল। কালী-দুর্গাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কথা প্রকারান্তরে স্বীকার করে নিয়ে রঘুনাথবাবুর দাবি, ‘‘কালী-দুর্গা ওই বার কিংবা সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত নয়।’’

হরিদেবপুর থানার কয়েক জন অফিসার অবশ্য পাল্টা আঙুল তুলছেন গুন্ডাদমন শাখার দিকে। থানার একাধিক অফিসারের বক্তব্য, বলছেন, এই ঘটনায় নান্টি, কালা, ভোৎকা, বাপ্পা নামে যে সব দুষ্কৃতীর নাম উঠে এসেছে, তাদের সঙ্গে গুন্ডাদমন শাখার অনেকেরই ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। এরা কয়েক জন তাঁদের ‘সোর্স’ হিসেবে কাজ করে। লালবাজারের একটি সূত্রের খবর, ডাবলুকে গত ডিসেম্বর মাসেই অস্ত্র আইনের মামলায় গ্রেফতার করেছিল গুন্ডাদমন শাখা। মাস কয়েকের মধ্যেই সে জামিনে মুক্তি পায়।

পুলিশ জানায়, হরিদেবপুর কাণ্ডে অভিযুক্তদের অনেকেই সোনারপুর-রেনিয়া তল্লাটের বাসিন্দা। সেখানে আগে জ্ঞানসাগর শর্মা নামে অস্ত্রের কারবারি এক দুষ্কৃতীর দাপট ছিল। একটি খুনের মামলায় জ্ঞানসাগর গ্রেফতার হওয়ার পর নান্টি, বাপ্পারাই এলাকার দখল নিয়েছে। এ বার নিজেদের কব্জায় থাকা এলাকার পরিধি বাড়াতে তারা এগোচ্ছিল কালী-দুর্গার খাসতালুকে। এই কথা জানার পরেও গুন্ডাদমন শাখা বিশেষ কোনও ব্যবস্থা নেয়নি।

কলকাতা পুলিশের প্রাক্তন সহকারী কমিশনার বিকাশ চট্টোপাধ্যায়ও মনে করেন, এই গোলমালের পিছনে পুলিশের গাফিলতি রয়েছে। সেই দায় পুলিশ এড়াতে পারে না। উপযুক্ত সময়ে ব্যবস্থা নিলে এই গোলমাল এড়ানো যেত। ‘‘তবে যা-ই ঘটুক না কেন, এই ঘটনায় অভিযুক্তদের এ বার গ্রেফতার করা হবে। এটাই আমি বিশ্বাস করি,’’ বলছেন বিকাশবাবু।

কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দাপ্রধান পল্লবকান্তি ঘোষ বলেন, ‘‘প্রশ্রয়ের অভিযোগ ভিত্তিহীন। নান্টি-ডাবলুকে গুন্ডাদমন শাখা আগেও গ্রেফতার করেছে। দুষ্কৃতীদের আড়াল করার চেষ্টা হলে গ্রেফতার করা হতো না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

police bar lalbazar sonarpur
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE