Advertisement
০৫ মে ২০২৪

এখানে সবই ঝাপসা, প্রেসিডেন্সি ছাড়লেন অধ্যাপক

কেউ দেখিয়েছেন ব্যক্তিগত কারণ। আবার পারিশ্রমিকের পরিমাণে তুষ্ট হতে পারেননি কেউ কেউ। সেই সঙ্গে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণ হিসেবে অনেক শিক্ষক-অধ্যাপকই পঠনপাঠনের পরিবেশের অভাবকে দোষ দিয়েছেন। সেই কারণ দেখিয়ে এ বার প্রেসিডেন্সি ছাড়লেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক মইদুল ইসলামও।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৩:৪০
Share: Save:

কেউ দেখিয়েছেন ব্যক্তিগত কারণ। আবার পারিশ্রমিকের পরিমাণে তুষ্ট হতে পারেননি কেউ কেউ। সেই সঙ্গে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণ হিসেবে অনেক শিক্ষক-অধ্যাপকই পঠনপাঠনের পরিবেশের অভাবকে দোষ দিয়েছেন। সেই কারণ দেখিয়ে এ বার প্রেসিডেন্সি ছাড়লেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক মইদুল ইসলামও।

যে-সব শিক্ষক বা অধ্যাপক বেতনের স্বল্পতা বা ব্যক্তিগত কারণের কথা বলে ওই ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান ছেড়েছেন, তাঁদেরও অনেকে প্রেসিডেন্সির পাঠ-পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। গত জুলাইয়ে প্রেসিডেন্সি-ত্যাগের সময় ওখানে কাজের পরিবেশ নেই বলে অভিযোগ করেছিলেন পদার্থবিদ্যার আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু চেয়ার অধ্যাপক সব্যসাচী ভট্টাচার্য। একই সুরে মইদুল সাহেব বলেন, ‘‘কাজের পরিবেশ তো নেই-ই। ওখানে সব কিছুই যেন কেমন ঝাপসা!’’ প্রেসিডেন্সি থেকে এক বছরের ‘লিয়েন’ নিয়ে তিনি মঙ্গলবারেই যোগ দিয়েছেন সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সে।

রাজ্যের অন্য সব বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে প্রেসিডেন্সি বরাবরই বাড়তি গুরুত্ব পায়। তা সত্ত্বেও বারবার কাজের পরিবেশ তুলে শিক্ষকেরা কেন ওই বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন শিক্ষাবিদদের একাংশ। পড়ুয়াদেরও একটি বড় অংশ এতে উদ্বিগ্ন। কারণ এমনিতেই প্রেসিডেন্সি চলছে শিক্ষক-ঘাটতিতে। মেন্টর গ্রুপ গঠনের পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান উন্নয়নে দেশ-বিদেশ থেকে শিক্ষক আনার কথা বলা হয়েছে বারবার। কিন্তু শিক্ষক-ঘাটতি পূরণ হয়নি। উল্টে একের পর এক অধ্যাপক বিদায় নেওয়ায় শূন্যতা ক্রমশ বেড়েই চলেছে।

শিক্ষক-বিদায়ের স্রোত বন্ধ ছিল কিছু দিন। কিন্তু গত ডিসেম্বরে ইতিহাসের নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু চেয়ার অধ্যাপক সজল নাগকে দিয়ে আবার শুরু হয় বিদায় পর্ব। তার মাস পাঁচেক আগে চলে যান পদার্থবিজ্ঞানের বিভাগীয় প্রধান, অধ্যাপক সোমক রায়চৌধুরী। এবং সজলবাবুর পরে মইদুল সাহেব।

প্রেসিডেন্সির পঠনপাঠন ও গবেষণার মান বাড়াতে রাজ্যে একমাত্র ওই বিশ্ববিদ্যালয়েই রয়েছে মেন্টর গ্রুপ। দেশ-বিদেশ থেকে নামী অধ্যাপকদের নিয়ে আসার জন্য তৈরি হয়েছে কিছু চেয়ার প্রফেসর পদ। প্রেসিডেন্সিকে বিশ্ব-মানে উন্নীত করার লক্ষ্যপূরণে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইচ্ছেতেই ওই সব পদ গড়া হয়েছিল। কিন্তু সেই সম্মাননীয় পদ থেকেও কয়েক জন সরে গিয়েছেন। তাঁদের অনেকে এবং সদ্য প্রেসিডেন্সি ছেড়ে যাওয়া মইদুল সাহেবও ওখানে কাজের পরিবেশের অভাবের কথা তোলায় রাজ্যের উচ্চশিক্ষা দফতর উদ্বিগ্ন। শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় গত রবিবারেই প্রশ্ন তুলেছেন, প্রেসিডেন্সি-যাদবপুরে পঠনপাঠনে এত বিঘ্ন কেন? এর দায় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষকেই নিতে হবে বলে জানিয়ে দেন তিনি।

কাজের পরিবেশ না-থাকার অভিযোগের সঙ্গেই প্রেসিডেন্সিতে ‘অস্বচ্ছতা’র কথা তুলেছেন মইদুল সাহেব। তাঁর অভিযোগ, ‘‘প্রেসিডেন্সিতে সব কিছুই অস্বচ্ছ হয়ে পড়েছে। একের পর এক শিক্ষক ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। তাঁরা কেন যাচ্ছেন, তাঁদের আটকাতেই বা কী পদক্ষেপ করা হচ্ছে— কিছুই বোঝা যাচ্ছে না!’’ অস্বচ্ছতা কি আর্থিক ক্ষেত্রে? সরাসরি জবাব না-দিয়ে ওই অধ্যাপক বলেন, ‘‘সব কিছুই কেমন যেন ঝাপসা!’’ তবে তাঁর আশ্বাস, কোনও দিন পরিবেশ ঠিক হলে তিনি প্রেসিডেন্সিতে ফিরতে পারেন। অতিথি অধ্যাপক হিসেবে ডাকলে তিনি যে পড়াতে আসবেন, লিয়েনের চিঠিতে সেটাও উল্লেখ করেছেন ওই অধ্যাপক।

এ-রকম আশ্বাসে অবশ্য মূল সমস্যার কোনও সুরাহা দেখছে না শিক্ষা শিবির। শিক্ষক বিদায়ের পালা শুরু হয়েছিল ইতিহাস বিভাগের বেঞ্জামিন জাকারিয়াকে দিয়ে। গত বছর মে মাস নাগাদ পদত্যাগ করেন ইতিহাস বিভাগের প্রধান শুক্লা সান্যাল। বিদেশ থেকে আসা জীবনবিজ্ঞানের অধ্যাপক অধীর মান্নাও প্রেসিডেন্সি ছেড়ে যান গত বছর। তার পরে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক সব্যসাচীবাবু কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে এবং পরিবেশ না-থাকার অভিযোগ তুলে ফিরে যান মুম্বইয়ে। পদার্থবিজ্ঞানের বিভাগীয় প্রধান সোমকবাবু, ইতিহাসের সজলবাবু ছাড়াও বিদায় নিয়েছেন বাংলার বিভাগীয় প্রধান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তারও আগে কয়েকটি বিভাগ থেকে কিছু শিক্ষক চলে গিয়েছেন বেতন-সহ বিভিন্ন বিষয়ে ক্ষোভ উগরে দিয়ে।

সব শিক্ষকের বিদায় নিয়েই জল্পনার জোয়ার ওঠে। এ বারেও উঠছে। সব থেকে বড় হয়ে উঠছে কাজের পরিবেশ না-থাকার অভিযোগটি। যাদবপুর-প্রেসিডেন্সিতে পঠনপাঠনে ব্যাঘাতবিঘ্ন প্রসঙ্গে নরেন্দ্রপুর-সেন্ট জেভিয়ার্সের মসৃণ পাঠপ্রবাহের তুলনা টেনেছিলেন শিক্ষামন্ত্রী। উদ্বিগ্ন শিক্ষাবিদদের বক্তব্য, স্বাস্থ্য-সহ ব্যক্তিগত কারণে কোনও শিক্ষক যদি প্রতিষ্ঠান ছাড়েন, বলার বিশেষ কিছু থাকে না। কিন্তু যাঁরা প্রেসিডেন্সি ছেড়ে যাচ্ছেন, তাঁদের অনেকেই পরিবেশ নিয়ে অভিযোগ তুলছেন এবং এটাই সব থেকে চিন্তার। শিক্ষাবিদ প্রবিত্র সরকার বলেন, ‘‘বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি কাজের পরিবেশ না-থাকে, তা হলে কী ভাবে সেটা ফিরিয়ে আনা যায়, সেটা উপাচার্য-সহ বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষকেই ঠিক করতে হবে।’’

পরিবেশের দিকে আঙুল তুলে আরও এক অধ্যাপক বিদায় নেওয়ায় উদ্বিগ্ন প্রেসিডেন্সির প্রাক্তনী সংগঠনের সম্পাদক বিভাস চৌধুরীও। তিনি বলেন, ‘‘কর্মপরিবেশের অভাবের অভিযোগ তুলে কেউ যদি প্রেসিডেন্সি ছেড়ে চলে যান, সেটা সত্যিই উদ্বেগের। এতে প্রেসিডেন্সি সম্পর্কে ভুল বার্তা যাবে বাইরে।’’

কাজের পরিবেশ না-থাকার অভিযোগ খারিজ করে দিয়েছেন উপাচার্য অনুরাধা লোহিয়া। তিনি বলেন, ‘‘উনি (মইদুল ইসলাম) আমার কাছে এই ধরনের কোনও অভিযোগই করেননি। উনি শুধু জানিয়েছেন, গবেষণা করতে চান। এর বেশি আমি কিছু বলব না।’’

মইদুল সাহেব অস্বচ্ছতার যে-অভিযোগ তুলেছেন, উপাচার্য সেই বিষয়েও নীরব। প্রেসিডেন্সির এক প্রবীণ অধ্যাপকের মতে, গলদটা অন্য জায়গায়। প্রেসিডেন্সিকে বিশ্ববিদ্যালয় করা হল। কিন্তু সর্বক্ষেত্রেই তাকে রাজ্য সরকারের অনুগ্রহ নিয়ে চলতে হচ্ছে। বিদেশ থেকে শিক্ষক নিয়ে আসা হল, কিন্তু তাঁদের যথাযথ সম্মানিক দেওয়া হল না। ‘‘এমন প্রেসিডেন্সি আমরা চাইনি। যথাযথ বেতন না-পেলে বাইরের কৃতী অধ্যাপকেরা পড়াতে আসবেন কেন,’’ প্রশ্ন ওই অধ্যাপকের।

এই প্রশ্নের নিহিত যুক্তিটা মেনে নিচ্ছেন উচ্চশিক্ষা দফতরের অনেক কর্তাও। এক কর্তার মন্তব্য, বাইরের যে-সব অধ্যাপক প্রেসিডেন্সিতে পড়াতে আসেন, তাঁদের অনেকেরই আর্থিক লোকসান হয়। প্রেসিডেন্সির জন্য কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সমতুল বেতন-কাঠামো তৈরি করতে পারেনি পশ্চিমবঙ্গ সরকার। মূলত বেতনের প্রশ্নেই অন্য জায়গা থেকে আসা শিক্ষকেরা প্রেসিডেন্সি ছাড়ছেন বলে মনে করেন ওই উচ্চশিক্ষা-কর্তা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

presidency professor resign
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE