Advertisement
E-Paper

বুক ভরা মা ডাকতে সেজেছে মাদার হাউস

আটপৌরে বাড়িটার গা বেয়ে লম্বা ফ্লেক্স হয়ে নেমে আসছেন তিনি। নীল পাড় সাদা শাড়ির ছোট্টখাট্টো নারী একদৃষ্টে কলকাতার দিকে তাকিয়ে।তাঁর ক্ষীণ, খর্বাকৃতি অবয়ব এখন আক্ষরিক অর্থেই অতিলৌকিক হয়ে উঠেছে। শনিবার দিনভর আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোডের ‘মাদার হাউস’ প্রাঙ্গণ যেন সেটাই বলে গেল।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০২:০৬
সন্তায়নের আগে। শনিবার, মাদার টেরিজার সমাধিতে। — রণজিৎ নন্দী

সন্তায়নের আগে। শনিবার, মাদার টেরিজার সমাধিতে। — রণজিৎ নন্দী

আটপৌরে বাড়িটার গা বেয়ে লম্বা ফ্লেক্স হয়ে নেমে আসছেন তিনি। নীল পাড় সাদা শাড়ির ছোট্টখাট্টো নারী একদৃষ্টে কলকাতার দিকে তাকিয়ে।

তাঁর ক্ষীণ, খর্বাকৃতি অবয়ব এখন আক্ষরিক অর্থেই অতিলৌকিক হয়ে উঠেছে। শনিবার দিনভর আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোডের ‘মাদার হাউস’ প্রাঙ্গণ যেন সেটাই বলে গেল।

আজ, রবিবার কলকাতার মা টেরিজা সন্ত হবেন সূদূর রোম লাগোয়া ভ্যাটিকানে। তার কয়েক ঘণ্টা আগে জোড়া গির্জার কাছে শহরের এই তল্লাটই যেন দুনিয়ার চোখে কলকাতার মুখ হয়ে উঠেছে।

ভাদ্র মাসের ঘ্যানঘেনে বৃষ্টিকে থোড়াই কেয়ার! দুপুর থেকে বিকেল জুড়ে সাদা-কালো-বাদামি কিংবা চ্যাপ্টা-লম্বাটে-গোলাকার মুখের আনাগোনা। সুইস-জার্মান মহিলা আমান্ডা না হয় বছরে তিন মাস কলকাতায় মাদারের থানে পড়ে থাকেন! ‘মাদার হাউস’-এর স্বেচ্ছাসেবী, জাপানের কলেজছাত্রী ইয়ুকি, শিনিয়াদের কাছে আবার টেরিজা মানে সেবাকাজের মুখ। আর রয়েছেন ধর্মে খ্রিস্টান না হয়েও এই বিশেষ লগ্নে কলকাতায় কাটানোর জন্য যাঁরা মুখিয়ে ছিলেন।

শহরের বেসরকারি হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মী, কেরলের আলেপ্পির শালিনী ও সমীর ডিউটির ফাঁকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মাদার হাউসে পড়ে রয়েছেন। কোচির শিবু জনও ভ্যাটিকানে মাদারের ‘সন্তায়ন’-এর দিন ঘোষণার খবর পেয়েই সপরিবার কলকাতার টিকিট কেটেছেন। চলে এসেছেন মুম্বইয়ের সামান্থা-হাইডি, গোয়ার ভাস্কোর টমাস ডি’সুজাও।

মন্ট্রিয়লের ডেনিস পারান্ট তিন দশক আগে হাইতিতে ‘মিশনারিজ অব চ্যারিটি’র সেবাকাজে সামিল হয়েছিলেন। এ বার ভুটান বেড়ানোর সময়ে দিনক্ষণ হিসেব করেই তিনি এখন কলকাতায়। ক্যালিফর্নিয়ার সিংহলী বংশোদ্ভূত উমা ব্যানসির সঙ্গে দেখা হল ঠিক ‘মাদার হাউস’-এর গলির মুখে। ইতিহাসের সাক্ষী হতে তাঁরও প্রথমবার কলকাতায় আসা!

তা কলকাতায় না এসে সটান ভ্যাটিকানে চলে গেলেই তো পারতেন!

শুনে ছাতা মাথায় মধ্যবয়সিনী থমকে দাঁড়ালেন। ‘‘কিন্তু আমি যে মাদারের সমাধির কাছে থাকতে চেয়েছিলাম!’’— বলতে বলতে চোখে জল এল তাঁর। ‘মাদার হাউস’-এর ভিতরে টেরিজার সমাধিস্থল তথা একতলার ঘরটি থেকে তখন সুর ভেসে আসছে। তিলজলা রোডের হোম ‘প্রেমদান’ থেকে সুস্থ হয়ে আসা আবাসিকেরা মাদারের গান ধরেছেন, ‘বল না এ বুকভরা মা ডাক কোথায় পাব’! টেরিজার বাঁধানো সমাধিস্থল ঘিরে ভক্তের ভিড়। চলছে প্রার্থনা।

ভ্যাটিকান সিটির সময়ের সঙ্গে ঘড়ি মিলিয়ে কলকাতায় রবিবার দুপুরে এই ঘরটিতেই পর্দা ফেলে সরাসরি টেরিজার সন্ত-স্বীকৃতির অনুষ্ঠান চাক্ষুষ করা যাবে। দোতলাতেও অনুষ্ঠান দেখবেন সিস্টারকুল এবং কিছু অতিথি। কলকাতা থেকে জনা কুড়ি সন্ন্যাসিনী ভ্যাটিকান সিটিতে গিয়েছেন। ‘মিশনারিজ অব চ্যারিটি’র সব হোমেই আবাসিকেরা একসঙ্গে টিভিতে অনুষ্ঠান দেখবেন। ‘মাদার হাউস’-এ অনুষ্ঠান শেষে বসবে বিশেষ প্রার্থনার আসর। শহরের বহু মিশনারি স্কুলেও যেন এখন উৎসবের সুর। সন্তায়নের পরে বৌবাজারের লোরেটো ডে স্কুল, সেন্ট লরেন্স স্কুল, সেন্ট জেমসে সপ্তাহভর অনুষ্ঠানের নির্ঘণ্ট। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট স্কুলে রবিবারও আসবেন অনেক পড়ুয়া-শিক্ষক। তাঁরা সকলে মিলে একসঙ্গে দেখা হবে ভ্যাটিকানের অনুষ্ঠান। স্কুলে এখন চলছে মাদারের ছবিতে ভরপুর এক প্রদর্শনীও।

এ শহরে টেরিজার দীর্ঘদিনের সঙ্গী তথা ‘মিশনারিজ অব চ্যারিটি’র অন্যতম মুখপাত্র সুনীতা কুমারও বাড়িতে অনুষ্ঠান দেখে বিশেষ প্রার্থনায় যোগ দিতে ‘মাদার হাউস’-এ যাবেন। মাদারময় এই কলকাতার কাছে ‘মাদার হাউস’-ই যেন ভ্যাটিকানের মুখ। ওই তল্লাটে রাজপথের ধারে কলকাতা পুরসভাও ‘মাদার’-কে নিয়ে অনুষ্ঠানের জন্য মঞ্চ বেঁধেছে। টেরিজার ছবি দেওয়া ঘড়ি, আংটি, চাবির রিং, টি-শার্ট থেকে শুরু করে নানা কিসিমের স্মারকের পসরা সাজিয়ে দোকানে বসেছেন ফতিমা চৌধুরী ও শেখ নুরুদ্দিন। আগে ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম সারাইয়ের কারবার ছিল তাঁদের। এখন দোকান জুড়ে শুধুই টেরিজা। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে নুর বিদেশি সাহেব-মেমদের গল্প শোনাচ্ছেন, কেমন টুকটুক করে হেঁটে এসে ‘মাদার’ নিজে তাঁকে স্পষ্ট বাংলায় ডাকতেন, তাঁর সাধের পিয়ানোয় গড়বড় হলে সারিয়ে দেওয়ার আবদার করতেন।

শহরের মাটিতে মিশে থাকা নোবেলজয়ী সন্ন্যাসিনীকে নিয়ে আবেগে জাতধর্মের ফারাক অবান্তর! তাতেই টেরিজার ‘চমৎকার’ টের পাচ্ছে কলকাতা।

Mother teresa
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy