Advertisement
০৫ মে ২০২৪

বিয়েবাড়িতে জ্বলবে না রঙিন আলো

ছেলে দু’টো পাড়ায় ঢুকলেই চিৎকার করে ডাক দিত। সেই আওয়াজটাই যেন শনিবার বারবেলায় বারবার কানে বাজছিল সকলের।

দুর্ঘটনার খবর পেয়ে বিয়েবাড়ির সামনে ভিড় করেছেন পড়শিরা)। শনিবার। নিজস্ব চিত্র

দুর্ঘটনার খবর পেয়ে বিয়েবাড়ির সামনে ভিড় করেছেন পড়শিরা)। শনিবার। নিজস্ব চিত্র

তানিয়া বন্দ্যোপাধ্যায় ও সৌরভ দত্ত
শেষ আপডেট: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০৩:১৩
Share: Save:

শুরুটা হয়েছিল আর পাঁচটা বিয়েবাড়ির মতোই। হইচই, কোলাহলে ভরে গিয়েছিল দোতলা বাড়িটা। বেলা গড়াতেই হঠাৎ ঘটল ছন্দপতন। বন্ধ হল সানাই। গায়ে হলুদের পর্ব মেটানো হল কোনওমতে।

ছেলে দু’টো পাড়ায় ঢুকলেই চিৎকার করে ডাক দিত। সেই আওয়াজটাই যেন শনিবার বারবেলায় বারবার কানে বাজছিল সকলের।

বন্ধুর দাদার বিয়েতে সকাল থেকেই নেমন্তন্ন ছিল ওদের। যদিও ভোরের অনুষ্ঠানে পৌঁছতে পারেনি ওরা। বন্ধু ফোন করতেই জানিয়েছিল, একটু বেলা হলে মিষ্টি নিয়ে একেবারে হাজির হবে বিয়েবাড়িতে। সেই কথামতো এ দিন বিয়েবাড়ির মিষ্টি কিনে সাইকেলে চ়ড়ে সুকান্তনগর যাচ্ছিল সঞ্জয় বনু এবং বিশ্বজিৎ ভুঁইয়া। চিংড়িঘাটা মোড়ে বাসের ধাক্কায় পিষ্ট হয় দু’জনেই। বেলা বারোটা নাগাদ দুর্ঘটনার খবর যখন পৌঁছল, বিয়েবাড়িতে তখন গায়ে হলুদের প্রস্তুতি চলছে।

দাদার বিয়ে নিয়ে কবে থেকে বিশ্বজিৎ ও সঞ্জয়ের সঙ্গে কত রকম পরিকল্পনা করেছে সায়ন বরা। বিয়েবাড়িতে পরার জন্য পোশাক, জুতো কিনেছিল ওরা সকলে। শুক্রবার সন্ধ্যায় আলো দিয়ে বা়ড়ি সাজানোর সময়েও তো রাস্তায় দাঁড়িয়ে নজর রেখেছিল বন্ধুরা। শনিবার আর সেই রঙিন আলো জ্বালাবে না বলেই ঠিক করেছে বরা পরিবার।

দাদা সৌরভের গায়ে হলুদের প্রস্তুতি পর্ব যখন চলছে, বার কয়েক বিশ্বজিৎ আর সঞ্জয়কে ফোনও করেছিল সায়ন। কিন্তু কোনও ভাবেই যোগাযোগ করতে পারেননি। এর মধ্যেই আর এক বন্ধু ফোন করে জানায় দুর্ঘটনার খবর। কোনওমতে গায়ে হলুদের পর্ব সেরে মেয়ের বাড়ি তত্ত্ব নিয়ে বেরোনোর মুখে আত্মীয়েরা দেখেন, এলাকায় থিকথিক করছে ভিড়। ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন পাড়ার লোকজন। লাঠি হাতে তাঁদের দিকে তেড়ে যাচ্ছে পুলিশও। সাজানো মাছ, নতুন শাড়ি হাতে চেপে দৌড়ে বাড়িতে ঢুকে পড়েন বরা বা়ড়ির আত্মীয়েরা। কিছু দূরেই মেয়ের বাড়ি। দুর্ঘটনা ঘিরে গোলমালের আঁচ গিয়েছে সেখানেও।

এ দিন বিকেলে বরা বাড়ির সামনে ভিড় জমেছিল। তবে সে ভিড়ে ছিল না সাজগোজ, হইচই কিংবা হাসির শব্দ। কেউ আওয়াজ তুলেছিলেন পুলিশের লাঠিচার্জ নিয়ে, কেউ আবার ট্র্যাফিকের নজরদারির অভাব নিয়ে সরব হয়েছিলেন। সেই ভিড়ে দাঁড়িয়েছিলেন সায়নের মা গীতাদেবীও। এক আত্মীয় তাড়া দিয়ে বলেন, ‘‘সময় চলে যাচ্ছে, ছেলেকে বরণ করো।’’ চোখের কোণ চিকচিক করে ওঠে গীতাদেবীর। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘‘ছেলে দু’টো এ ভাবে চলে গেল! মেনে নিতে পারছি না।’’

এই ঘটনা ঘিরে হওয়া বাইপাসের যানজটে আটকে পড়েন বিয়েবাড়ির বহু অতিথিও। তার মধ্যে দিয়ে কনের বাড়িতে তাঁদের নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব প়ড়ে সায়নের উপরেই। অশান্ত পরিস্থিতিতে কী ভাবে কনের বাড়িতে পৌঁছবে বর, তা নিয়েও চিন্তায় পড়ে বরা পরিবার। সায়নের পিসি বেবি বরা বলেন, ‘‘প্রতিবেশীদেরই অনুরোধ করব, ছেলেটা যাতে কোনওমতে সময়ে পৌঁছতে পারে, সেটুকু ব্যবস্থা করতে। না হলে আরও দু’টো পরিবার ভেসে যাবে।’’

এ দিনের গোলমালের জেরে সমস্যায় পড়ে আরও একটি পরিবার। সকালে রামপদ মণ্ডলের মা সরস্বতী মণ্ডলের শ্রাদ্ধের কাজ করতে শান্তিনগরে গিয়েছিলেন পুরোহিত সঞ্জিত চক্রবর্তী। রাস্তার জমায়েত হটাতে বিক্ষোভকারীদের তাড়া করে পুলিশ। সেই সময়ে পুলিশের মারমুখী মেজাজের সামনে পড়ে যান সঞ্জিতবাবু। পরে তিনি জানান, শ্রাদ্ধের প্যান্ডেলের আড়াল থেকে বুঝতে পারিনি, বাইরে কী হচ্ছে। আচমকা প্যান্ডেলের উপরে ইটের টুকরো পড়তে থাকলে তড়িঘড়ি ঘরের ভিতরে ঢুকে যান তিনি। সঞ্জিতবাবু বলেন, ‘‘বলছি, শ্রাদ্ধের কাজ করতে এসেছি। কে শোনে কার কথা! লাথি মেরে দরজা ভেঙেই দিল।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE