তাঁর বয়ঃসন্ধির শুরুতে খানিকটা অভিমান করেই সন্দীপ রায় বলেছিলেন সত্যজিতের ছবি প্রসঙ্গে, বাবা শুধু বড়দের জন্যেই বিষণ্ণ সব ছবি বানায়। ছেলের অভিমান মোছাতে ছোটদের জন্য রূপকথার ছন্দে এমন এক আশ্চর্য পৃথিবী তুলে এনেছিলেন সত্যজিৎ গুপী গাইন বাঘা বাইন ছবিতে, যেখানে গুপী-বাঘার গান-বাদ্যের তালে খেয়াল-খুশি-অসম্ভবের নেশায় মেতে উঠেছিল নিসর্গ থেকে মানুষ। শিল্প আর বিনোদনের এমন আত্মীয়তা এর আগে চ্যাপলিনের ছবি ছাড়া আর কোথাও দেখা গেছে কি?
‘পূর্ণিমা পিকচার্স’ নিবেদিত এ ছবির মুক্তির (১৯৬৯) পঞ্চাশ বছর পেরিয়েও আজও তার গুণমুগ্ধ বাঙালি। আর এই ছবির চমৎকারিত্ব নির্মাণের সব উপকরণ, প্রস্তুতির সরঞ্জাম সঞ্চিত সত্যজিতের খেরোর খাতায়, সন্দীপ রায়ের হেফাজতে। ‘গুগাবাবা’-র খেরোর খাতা দু’টি, একটিতে ছবির যাবতীয় খুঁটিনাটি, অন্যটিতে ভূতের নাচের অংশটুকু। সত্যজিৎ-জন্মশতবর্ষে জবর খবর, সেই সমস্ত কিছু নিয়েই প্রকাশ পাচ্ছে একটি ওয়েবসাইট— এক্সপ্লোর রে ডট ওআরজি, সঙ্গে ‘ফিল্ম বুক’ জিজিবিবি/ মাইন্ড অব আ জিনিয়াস/ রে অ্যান্ড হিজ় খেরোর খাতা। উদ্যোক্তা ‘দ্য চ্যাটার্জি গ্রুপ (টিসিজি)’, তাদের ‘সেন্টার্স ফর রিসার্চ অ্যান্ড এডুকেশন ইন সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’-র তত্ত্বাবধানে নতুন প্রকল্প ‘সেন্টার ফর নিউ মিডিয়া’-র প্রথম কাজই এটি। অয়নাংশু বন্দ্যোপাধ্যায় ও অনুব্রত চক্রবর্তী, দায়িত্বপ্রাপ্ত টেকনোলজিদুরস্ত ও সংস্কৃতিমনস্ক দুই তরুণের মধ্যে অয়নাংশু জানালেন, “সত্যজিতের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য তো বটেই, তাঁর গুগাবাবা নিয়ে এই যাত্রার ভিতর দিয়ে ডিজিটাল এন্টারটেনমেন্টের নতুন ভাষা খুঁজলাম আমরা। ‘গুগাবাবা’-র এই বিপুল সম্ভার আগে এ ভাবে কখনও প্রকাশ্যে আসেনি। সবার জন্য দরজা খুলে যাচ্ছে, প্রত্যেকে তাঁদের ডেস্কটপ, ল্যাপটপ, মোবাইলে গুগাবাবা-কে নতুন করে আবিষ্কার করতে পারবেন।” অনুব্রতর মতে, “একটি উপাদান দেখতে দেখতে অনায়াসে অন্য উপাদানে যাওয়া যাবে... উপেন্দ্রকিশোরের কাহিনি থেকে সত্যজিতের চিত্রনাট্য, স্টোরি বোর্ড, মিউজ়িক নোটেশন, কস্টিউম ডিজ়াইন, চরিত্র আর সেটের স্কেচ, পোস্টার, লবি কার্ড, ফিল্ম স্টিল, বুকলেট... সব কিছুতেই।”
শিকাগো থেকে খেয়াল করিয়ে দেন এ প্রকল্পের টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজ়ার, মৃণাল সেনের পুত্র কুণাল সেন— এ কিন্তু বই নয়, ওয়েবসাইট, তাই “মূল্যবান সংযোজনে ক্রমাগত ঋদ্ধ করা যেতেই পারে তাকে। প্রকল্পের অধিকর্তা, বিশিষ্ট পদার্থবিদ সব্যসাচী ভট্টাচার্যের আহ্বানে এই অভিনব ভাবনার কাঠামো তৈরির কাজে যোগ দিয়েছি, আনন্দও পেয়েছি। আরও আনন্দ সন্দীপের সঙ্গে কাজ করার, ওর সঙ্গে আগে কখনও কাজ করিনি তো, আমরা একই স্কুলে পড়েছি ছোট থেকে।” আনন্দ সন্দীপ রায়েরও, “খেরোর খাতা নিয়ে এমন কাজ আগে কেউ করেননি, বাবার শতবর্ষে তা হচ্ছে, আর সকলে তাতে যুক্ত হতে পারছেন, এ তো আনন্দের কথা।”