Advertisement
২২ মে ২০২৪

এক এক্কে এক, দুই এক্কে এক, ছবি আঁকছেন পার্থ

ছোট্ট একটা ইটের টুকরো। সেটা দিয়েই ওয়ার্ডের মেঝেতে একটা মুখ এঁকেছিলেন তিনি। অস্পষ্ট একটা মেয়ের মুখ। ওয়ার্ডের অন্য রোগীরা সে সময় তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁদেরই এক জন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘ইনি আপনার মা?’’ উত্তর না দিয়ে মুচকি হাসলেন পার্থ দে। আর এক জন প্রশ্ন করলেন, ‘‘ইনি কি আপনার বোন না দিদি?’’ মাথা দুলিয়ে হাসতে হাসতে পার্থ বললেন, ‘‘সেটাই তো ধাঁধা! এক এক্কে এক। দুই এক্কেও এক!’’ বলতে বলতেই আঁকাটা ঘষে ঘষে মুছেও দিলেন।

রবিবার জিজ্ঞাসাবাদের পরে অরুণ দে।

রবিবার জিজ্ঞাসাবাদের পরে অরুণ দে।

শেষ আপডেট: ১৫ জুন ২০১৫ ০৪:২৭
Share: Save:

ছোট্ট একটা ইটের টুকরো। সেটা দিয়েই ওয়ার্ডের মেঝেতে একটা মুখ এঁকেছিলেন তিনি। অস্পষ্ট একটা মেয়ের মুখ। ওয়ার্ডের অন্য রোগীরা সে সময় তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁদেরই এক জন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘ইনি আপনার মা?’’ উত্তর না দিয়ে মুচকি হাসলেন পার্থ দে। আর এক জন প্রশ্ন করলেন, ‘‘ইনি কি আপনার বোন না দিদি?’’ মাথা দুলিয়ে হাসতে হাসতে পার্থ বললেন, ‘‘সেটাই তো ধাঁধা! এক এক্কে এক। দুই এক্কেও এক!’’ বলতে বলতেই আঁকাটা ঘষে ঘষে মুছেও দিলেন।

আঁকার সঙ্গে লেখাও আছে। সেটাও কিছু কম ধাঁধা নয়। রবিবার সকালে পাভলভ হাসপাতালে পার্থবাবু খাতা ভর্তি করে দুর্বোধ্য ভাষায় যা সব লিখেছেন, কাউন্সেলররা তার পাঠোদ্ধার করতে পারেননি। তাঁদের অনুমান, ওটা কন্নড় ভাষা। দে পরিবার দীর্ঘদিন বেঙ্গালুরুতে ছিল। পার্থ ও দেবযানী সেখানেই পড়াশোনা করেছেন। ফলে কন্নড় ভাষা জানাটা তাঁর পক্ষে অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সাধারণত মানুষ যে ভাষায় স্বছন্দ হয়, তাতেই লিখে মনের ভাব প্রকাশ করতে চায়। পার্থবাবু যে এমনিতে ইংরেজিতেই কথা বলতে ও লিখতে অভ্যস্ত, সেটা এত দিনে মোটামুটি পরিষ্কার। রবিনসন স্ট্রিটের ফ্ল্যাটে তাঁর যে সব ডায়েরি পাওয়া গিয়েছে, সেখানেও তিনি ইংরেজিতেই সব কথা লিখেছেন। তাই আচমকা অন্য ভাষায় তাঁর লেখালেখি করতে দেখে মনোবিদরা বিস্মিত। যা লিখছেন তা যাতে পাভলভের কেউ পড়তে না পারেন— সে জন্যই কি কন্নড় ভাষার শরণাপন্ন হলেন পার্থ? এতটা ভেবে কাজ করার মতো মানসিক অবস্থা কি তাঁর আছে? পাভলভ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, সব দিকটাই তাঁরা খতিয়ে দেখছেন। মনোবিদ মোহিত রণদীপ বলেন, ‘‘উনি যদি স্কিৎজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে থাকেন, সে ক্ষেত্রে উনি অনেক কিছু লিখতে পারেন। সেগুলি যথাযথ বিচার না করে আলগা মন্তব্য করলে মানসিক রোগ সম্পর্কে ভুল বার্তা যাবে।’’ আর আঁকিবুঁকি সম্পর্কে মনোবিদ জ্যোতির্ময় সমাদ্দারের মত হল, পার্থ কী বলছেন বা কার মুখ আঁকছেন, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। তিনি কাউকে বিভ্রান্ত করার জন্যও এমনটা করে থাকতে পারেন। ‘‘যে ঘোরতর পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার ওঁর রয়েছে, সেটা থেকে এমন করার প্রবণতা স্বাভাবিক। টানা দু’-তিন মাস মানসিক অবস্থা পরীক্ষা করা হলে তবেই বিষয়টা নির্ভুল ভাবে বোঝা সম্ভব হবে,’’ বলছেন জ্যোতির্ময়বাবু।

তবে হাসপাতালের চিকিৎসকদের পর্যবেক্ষণ, পার্থর আচরণে ধীরে ধীরে একটা বদল ধরা পড়ছে। পাভলভের সুপার গণেশ প্রসাদ এ দিন বলেন, ‘‘সকলের সঙ্গে এখন মিশতে চাইছেন পার্থ। ডেকে ডেকে কথা বলছেন, হাসিঠাট্টা করছেন। তাঁর কথায়, ‘‘কিছু একটা ভাগ করে নেওয়ার চেষ্টা নজরে পড়ছে ওঁর মধ্যে।’’ ফিটফাট থাকতে চাইছেন। ভাল ভাবে খেতে চাইছেন। হাসপাতাল সূত্রের খবর, এ দিন সকালে দাঁত মাজতে গিয়ে পার্থ কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করে বলেন, ‘‘এত খারাপ ব্রাশ ও পেস্ট দিয়ে আমি দাঁত মাজতে অভ্যস্ত নই।’’ তখন তাঁকে তাঁর পছন্দসই ব্রাশ দেওয়া হয়। প্রাতরাশ খেতে বসে পার্থ জানান, হ্যান্ড টিস্যু, ভাল প্লেট ও কাঁটাচামচ চাই তাঁর। এক নার্স অনেকক্ষণ বোঝানোর পরে অবশ্য তিনি কাঁটাচামচ ছাড়াই ডিম-পাঁউরুটি-কলা আর দুধ খান। খাওয়া শেষে জিজ্ঞাসা করেন, ‘‘আবার কখন বাইরে ঘুরতে যেতে পারব?’’ নার্স তাঁকে জানান, বিকেল চারটের সময় সব রোগী বাইরের খোলা জায়গায় ঘুরতে বের হন, খেলা করেন। তখন তিনিও বেরোতে পারবেন। তা শুনে পার্থ বিড়বিড় করতে থাকেন, ‘‘মিডিয়া আমার বাড়িতে ঢুকল! এটা উচিত হয়নি।’’

তার পর শুরু হল অন্য আব্দার, ‘‘একটা গাড়ির ব্যবস্থা করুন। আমি নিজেই ওখানে যাচ্ছি।’’ কোথায় যাবেন? পার্থর জবাব, ‘‘এ ভাবে সব কথা বার করে নেবেন, সেটি হচ্ছে না।’’ কুকুর দু’টি কী ভাবে মারা গেল, সেই প্রশ্নের উত্তরে শুধু বলেছেন, ‘‘ঈশ্বর ওদের নিয়ে নিয়েছেন। ঈশ্বরই সর্বত্র রয়েছেন। আমি যা করেছি তাঁর জন্য উনিই আমাকে দেখবেন।’’ দুপুরে খাওয়ার পরে বায়না জুড়লেন, ‘‘আমি লুডো খেলব। লুডো এনে দিন।’’ কিন্তু লুডোর ঘুঁটি নাকে-মুখে ঢুকে গিয়ে বিপদ হতে পারে, এই আশঙ্কা করে লুডো দেওয়া হয়নি তাঁকে। বিকেলে নার্সরা তাঁকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছেলেবেলা’ পড়তে দেন। প্রায় ঘণ্টাখানেক বইয়ের পাতা ওল্টান তিনি। কয়েক বার ঠান্ডা জল চেয়ে খেয়েছেন। রাতের খাবারের জন্য প্রথমে নার্সদের জানান, তিনি ওমলেট খেতে চান। কিছুক্ষণ পরে আবার মন বদলে তাঁদের বলেন, তিনি ডিমসেদ্ধ খেতে চান। সেটাই তাঁকে দেওয়া হয়েছে।

পাভলভের চিকিৎসকরা বলছেন, পার্থের উপরে নজর রাখা, কথা বলার পাশাপাশি ওঁর ঘনিষ্ঠদের সঙ্গেও কথা বলার প্রয়োজন রয়েছে। কারণ এ সব ক্ষেত্রে অসুখের ধরনটা বোঝার জন্য রোগীর অতীতটা জানা জরুরি। পার্থর বয়ঃসন্ধির সময়টা কেমন ছিল, সেটা জানতে হবে। ‘‘বয়ঃসন্ধিতেই হয়তো লুকিয়ে রয়েছে রহস্যের বীজ,’’ বলছেন এক চিকিৎসক। দীর্ঘদিন ধরে বাড়িতে নোংরা পরিবেশে থাকার ফলে পার্থর শরীরে চর্মরোগ দেখা দিয়েছে। নানা জায়গা থেকে রক্তও ঝরছে। দিন কয়েকের মধ্যেই পাভলভে এক জন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞকে এনে পার্থর চিকিৎসা করানোর কথা ভাবা হচ্ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE