Advertisement
০৫ মে ২০২৪

‘এক সঙ্গে কুড়ি হাজার টাকার পাঁচশো-হাজারের নোটও আনতে পারো’

কানে ধরা আইফোন সিক্স। অনবরত কথা বলে চলেছেন বছর পঞ্চাশের লোকটি— ‘‘স্যার চেষ্টা করব। আপনি বলেছেন, আমার জান হাজির। যতটা পারব করব, স্যার। কয়েকটা দিন সময় দিন, পরে সব বলছি।’’

শুভাশিস ঘটক
শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০১৬ ০১:৪০
Share: Save:

কানে ধরা আইফোন সিক্স। অনবরত কথা বলে চলেছেন বছর পঞ্চাশের লোকটি— ‘‘স্যার চেষ্টা করব। আপনি বলেছেন, আমার জান হাজির। যতটা পারব করব, স্যার। কয়েকটা দিন সময় দিন, পরে সব বলছি।’’ একটা ফোন নামিয়ে রেখেই আর একটা ধরলেন, ‘‘বোলিয়ে স্যারজি। চেষ্টায় আছি, স্যার। এখন মাথা খারাপ। পরে করে দেব।’’

পার্ক স্ট্রিট এলাকার একটি বহুতলে এক শেয়ার ব্রোকারের হাজার দুয়েক বর্গফুটের অফিস। একেবারে যেন ‘ওয়্যার হাউস’। চার দিকে একের পর এক টেবিলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গোটা দশেক ল্যাপটপ। জনা দশেক ছেলে ল্যাপটপ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছে। কেউ আবার কানে মোবাইল নিয়ে অনবরত কথা বলে চলেছে।

দাদার বড় টেবিলে ছড়িয়ে রয়েছে কম করে গোটা দশেক দামি মোবাইল ফোন। একটার পর একটা বেজেই চলেছে। একটা ধরে কথা বলছেন। একটিতে কথা বলতে বলতেই আর একটিতে চোখ। কয়েকটা ফোন ধরতে পারেননি। সুযোগ পেলেই মিস্ড কলের লিস্ট দেখে ‘কল ব্যাক’ করছেন। একই কথা, ‘‘স্যার, ক’দিন পরে দেখছি। এখন খুব চাপে আছি।’’

দামি সেগুন কাঠের বড় টেবিলের ও-পাশে বসে কলকাতার শেয়ার বাজারের প্রভাবশালী দালাল। শুধু শেয়ার বাজার নয়। কলকাতা থেকে বিদেশে টাকা পাঠানোর ‘হুন্ডি’ বাজারেরও তিনি এক নম্বর কারবারি বলেই পরিচিত। খবর সংগ্রহের সূত্রে এঁর সঙ্গে পরিচয় বছর দশেকের।

পকেটে নগদ নেই। অফিসের এটিএমে দু’হাজার টাকার বেশি দিচ্ছে না। ‘‘১০ হাজার টাকা খুচরো দেবে?,’’ ফোনে জি়জ্ঞেস করেছিলাম ওঁকে। ও-পাশ থেকে আশ্বাস দিয়ে জানিয়েছিলেন, ‘‘দশ নয়, এক সঙ্গে কুড়ি হাজার টাকার পাঁচশো-হাজারের নোটও আনতে পারো। একশো টাকার নোট নিয়ে যাও। বেশি জ্বালাবে না বস্‌। একেবারে ধসে গিয়েছি গো। মাথা কাজ করছে না। কুড়ি হাজার দিয়ে সপ্তাহখানেক চালাও।’’

পরদিন সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ ওই অফিসে হাজির হয়েছিলাম। সঙ্গে হাজার-পাঁচশোর নোট মিলিয়ে কুড়ি হাজার টাকা। ঘরে ঢুকে ‘দাদা’র মুখের চেহারা দেখে ভিতরে ভিতরে কিছুটা আঁতকে উঠেছিলাম। ধবধবে সুন্দর চেহারা ছিল। মুখের রং ছিল গোলাপি। এখন মাথার চুল এলোমেলো। আমি দরজা খুলে মুখ দেখালাম। মোবাইলে কথা বলতে বলতেই বসতে ইশারা করলেন। চেয়ারে বসার আগে পকেট থেকে টাকা বার করে টেবিলের উপরে রাখলাম। কথা শেষ হতেই টেবিলের ড্রয়ার থেকে দু’টি একশো টাকার নোটের বান্ডিল এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘‘রাখো।’’ আমার দেওয়া টাকা না গুনেই ঘরের এক কোণে ছুড়ে দিলেন। সে দিকে তাকিয়ে দেখি, পাঁচশো-হাজারের স্তূপ। বললাম, ‘‘এত টাকা?’’ শুকনো হেসে দাদা বললেন, ‘‘আর টাকা! আমার কাছে যা জমা হয়েছে, তা দিয়ে দু’লরি ভর্তি হয়ে যাবে।’’

কিন্তু সকাল থেকে তিনি কী করছেন? দাদা বললেন, ‘‘টাকার রং বদলাচ্ছি। মোটামুটি রাজ্য জুড়ে হাজার তিরিশেক গরিব মানুষের অ্যাকাউন্ট জোগাড় করেছি। উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় আমার ছেলেদের হাজার-পাঁচশোর নোট দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি। দু’হাজার খুচরো করে বদলাচ্ছি। কোথাও দু’লক্ষ টাকা অ্যাকাউন্টে ভরে দিচ্ছি। খুচরো টাকা এক সঙ্গে করে ফের ট্রেনে বা বাসে কলকাতায় ফেরত নিয়ে আসছি। দেখছ না, কোনও লাইনে কে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তার ছবি মোবাইলে পাঠাচ্ছে। কত টাকা বদল হল, খবর আসছে অনবরত। ট্র্যাভেল এজেন্সিকে বলে দিয়েছি, ট্রেন-বাসের টিকিট কনফার্ম করতে। একশো টাকার নোটে দাম দেব। না হলে সোনা দিয়ে দেব। টিকিট চাই। যেখানে-সেখানে টাকা ফেলে রাখা যাবে না। যত তাড়তাড়ি সম্ভব টাকা ঘরে তুলে নিতে হবে।

পার্ক স্ট্রিটের দাদা জান লড়িয়ে দিয়েছেন টাকার বং বদলাতে। এক্কেবারে উল্টো ছবির হদিস মিলল মেটিয়াবুরুজে কোটি কোটি টাকার কাপড় ব্যবসায়ীদের ডেরায়। সেখানকার এক ব্যবসায়ীকে ফোন করেছিলাম। পূর্ব পরিচয়ের সূত্রেই জানতাম, ওই ব্যবসায়ী নগদে প্রায় কয়েকশো কোটি টাকার ব্যবসা করেন। তাঁকে ফোন করে বললাম, হাজার বিশেক টাকা একশোর নোটে ব্যবস্থা করে দিতে। ফোনেই বলেছিলেন, ‘‘আসুন।’’ সকাল সকাল তাঁর মেটিয়াবুরুজের বটতলার অফিসে গিয়ে হাজির হলাম। ঘণ্টাখানেক বসেই রয়েছি। মালিকের দেখা নেই। এক কর্মচারী চা-জলখাবার দিয়ে গেলেন। বলে গেলেন, ‘‘সাহেব আপনাকে একটু বসতে বলেছেন।’’ আরও আধ ঘণ্টা পরে ‘সাহেব’ এলেন। চেহারায় ক্লান্তির ছাপ। কেমন আছেন? জিজ্ঞেস করতেই ধপাস করে সোফায় বসে পড়লেন। বললেন, ‘‘একেবারে ধসে গিয়েছি।’’ গুরু মারা বিদ্যা ফলানোর চেষ্টা করলাম। পার্ক স্ট্রিটের দাদার ছক ওঁকে বলে বসলাম। বললাম, ‘‘আপনার কাছে বহু শ্রমিক কাজ করেন তো। ওঁদের অ্যাকাউন্টে টাকা ফেলতে থাকুন। কিছুটা হলেও বাতিল কালো টাকা সাদা হয়ে যাবে।’’

মাথায় বেশ কয়েক বার হাত বুলিয়ে ওই ব্যবসায়ী বলেন, ‘‘তা হচ্ছে না। আমার কাছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার প্রায় দেড়শো শ্রমিক কাজ করেন। ওঁদের বলেছিলাম, ‘তোদের অ্যাকাউন্টে ফেল। আর গ্রামের লোকেদের রাজি করে অ্যাকাউন্টে ফেলার চেষ্টা কর ভাই।’ কিন্তু শুরুতেই ধাক্কা খেয়েছি। আমার কয়েক জন শ্রমিককে টাকা সমেত পুলিশ ধরে নিয়েছে। উল্টে ঝামেলা বেড়ে গিয়েছে। আমার নাম পুলিশের খাতায় উঠে গিয়েছে। আমার উপরে হয়তো আয়কর দফতর নজরদারিও শুরু করেছে।’’ এক কর্মচারীকে ডেকে পাঁচশোর নোটে পাঁচ হাজার টাকা আমার থেকে নিয়ে কুড়ি টাকার নোটের বান্ডিল দিলেন ওই ব্যবসায়ী। বললেন, ‘‘আর পারব না।’’ কিন্তু আপনার কত বাতিল কালো টাকা রয়েছে? চোখমুখ কুঁচকে বললেন, ‘‘হাতে রয়েছে প্রায় ৩০ কোটি।’’ কী হবে এখন? ‘‘কী আর হবে। ব্যবসা লাটে উঠবে। নোট পুড়িয়ে দিতে হবে। না হলে গরু চিবিয়ে খাবে।’’

ওই ব্যবসায়ীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আর এক পরিচিত কাপড় ব্যবসায়ীর অফিসে গিয়ে হাজির হলাম। অফিসে তাঁর ছেলে বসে। মুখ থমথমে। চার দিকে জনা বিশেক কর্মী। বাবা কোথায়? ছেলে জানালেন, ‘‘হাসপাতালে ভর্তি।’’ অবস্থা কেমন? উত্তর ‘‘মোটামুটি।’’ বাড়ির কাছেই একটি নাসিংহোমে ভর্তি রয়েছেন ওই ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ীর ছেলে এক কমর্চারীকে আমার সঙ্গে দিলেন। নার্সিংহোমে গিয়ে দেখা করলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘কেমন আছেন?’’ ছোট্ট উত্তর ‘‘খতম।’’ হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসার সময়ে ওই কর্মচারী বললেন, ‘‘পুলিশ ও আয়কর দফতরের ভয়ে সকলেই মুখ বন্ধ করে আছে। সাহেবের প্রায় ৬০ থেকে ৭০ কোটি টাকা খতম হয়ে গিয়েছে মনে হচ্ছে। কিছু করার নেই। সাহেবের পরিচিত কিছু লোক বলছেন, অন্তত কিছু টাকার রং বদলে দেবেন। কিন্তু কী ভাবে? তা বলছেন না। তা জানতেই সাহেবের ছেলে চার দিকে ফোন ঘুরিয়ে চলেছেন।’’

সে সাক্ষাতের পরেও কেটে গিয়েছে দিন কয়েক। কিন্তু টাকার অঙ্ক যে বড্ড বড়। রং বদল তো সহজ কথা নয়। সময় লাগেই।

অঙ্কন: সুমন চৌধুরী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Color of money Scrap notes Currency notes
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE